করোনার সংকটকালকে জয় করেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ – কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন

কৃষিবিদ ড. এম মনির উদ্দিন :

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অর্থনীতি এখনও কৃষি নির্ভর। কৃষিই দেশের মুল চালিকা শক্তি। আর এই চালিকা শক্তির মুলে যারা কাজ করছে তারা হলো আমাদের ফসল উৎপাদক কৃষক সমাজ, মৎস্য খামারী, ব্রয়লার খামারী, লেয়ার খামারী, ডেইরী খামারী সহ অন্যান্য কৃষিজ পন্য উৎপাদনকারী। করোনার এই সংকটময় মুহুর্তে দেশের মানুষ যখন ঘরের মধ্যে অবস্থান করছে ঠিক সেই সময়ে আমাদের কৃষক হাওড় এলাকায় ধান কাটতে ব্যস্ত, অন্য এলাকার কৃষকেরাও মাঠে ফসলের পরিচর্যায় ব্যস্ত। একই চিত্র আমরা দেখতে পাবো অন্যান্য খামারীদের ক্ষেত্রেও।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায় “কৃষকের কাছে জমি তার সন্তানের মত”। যত দুর্যোগ বা মহামারী আসুক না কেন, কৃষক তার জমিতে ফসল ফলিয়েই যাবে। করোনার কারনে গোটা বিশ্ব আজকে যেখানে হতাশায় ভুগছে। বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে মহা মন্দায় পড়তে যাচ্ছে, সেই সংকটময় সময়ে আমাদের কৃষকেরা আগামী মে মাসের মধ্যে আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে বোরো ফসল গোলায় তুলতে পারবে যা গোটা জাতির জন্য একটি বড় সাহস যোগাবে। নিশ্চয়ই, এটা আমাদের জন্য কষ্টের মধ্যেও একটি ভাল খবর কারন, খাদ্যাভাব যে কোন মহামারীর চেয়েও ভয়ানক।

মাত্র কয়েক মাস আগের কথা, দেশে মৌসুমের শেষের দিকে কিছু পেয়াজের ঘাটতি দেখা গেল। এর অত্যন্ত স্বাভাবিক কারন, পেয়াজ দেশে যথেষ্ট উৎপাদন হলেও পচনশীল হওয়ায় বেশ পরিমান পেয়াজ নষ্ট হয়ে যায় এবং এই ঘাটতি পাশের দেশ ভারত থেকে আমদানী করে মেটানো হয়। কিন্তু, ভারতে অকাল বন্যায় পেয়াজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা সাময়িকভাবে পেয়াজ রফতানী বন্ধ রাখে। এর ফলে বাজারে পেয়াজের দাম বেড়ে যায়। সাথে সাথে দেশের অনেক মিডিয়া এমনভাবে প্রচারে নামে যেন, পেয়াজ না খেলে মানূষ বাচবেনা। এখনো অনেক মিডিয়া নিয়মিতভাবে কৃষিজ কোন পন্যের দাম কত বাড়লো তা প্রচার করে থাকে।

কিন্তু, আমাদের কৃষক বা খামারীরা যে বিভিন্ন সময়ে লোকসান দিয়ে পন্য বিক্রয় করে থাকে তা অনেক মিডিয়ারই চোখে পড়েনা। করোনার কারনেও আমাদের কৃষক বা খামারীরা তাদের উৎপাদিত পন্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা। অথচ, এ ব্যাপারে মিডিয়াগুলো সামান্য একটু প্রচার করলেই খামারীদের হয়তো অনেক উপকার হতো। যেমন করোনার সময়ে মিডিয়াগুলো যদি একটি তথ্য যেমন, ”সুস্থ থাকুন, বেশী করে আমিষ জাতীয় খাবার যেমন- ব্রয়লার, ডিম, দুধ, মাছ খান” এ জাতীয় কিছু প্রচার করলে সাধারন মানুষ একটি ভাল তথ্য পেত এবং এ জাতীয় কৃষিজ পন্য বেশী ব্যবহারে উৎসাহিতও হতো।

যাহোক, বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের কৃষি ও কৃষকের পাশে আছেন। তার দক্ষ নেতৃত্বে, দেশ আজ কৃষিজ অনেক পন্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পুর্ন। আমাদের কৃষক ও খামারীরা করোনা পরিস্থিতিতে লোকসানে পড়লেও ঘুরে দাড়াবে অচিরেই। এই বিশ্বাস নিয়েই দেশের কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাইভেট সেক্টরসহ কৃষক/খামারীদের কাছে সবিনয়ে অনুরোধঃ

১) দেশের প্রাইভেট সেক্টর বিশেষ করে যে সকল প্রতিষ্ঠান ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগীর বাচ্চা উৎপাদন ও খামারী পর্যায়ে সরবরাহ করে থাকেন তারা আজকে বাচ্চা বিক্রয় করতে না পেরে মাটিতে পুতে ফেলছেন। এমন খবর অবশ্যই আমাদের ব্যথিত করে। দেশের এই সংকট সময়ে এ সকল প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুরোধ জানাবো যে, আপনারা উৎপাদিত বাচ্চাগুলো আপনাদের সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে খামারীদের খামারে নামমাত্র মুল্যে বা বিনামুল্যে হলেও তুলে দিন যাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারীরা টিকে থাকার পাশাপাশি দেশের আমিষ উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত থাকে। কারন, আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহতা’লা এই মহামারী থেকে আমাদের রক্ষা করবেন। সুতরাং এই ক্ষুদ্র খামারীদের টিকিয়ে রাখতে পারলে অবশ্যই আপনারা আপনাদের ক্ষতিকে আগামীতে কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

২) ব্রয়লার ও লেয়ার খামারী ভাইবোনদের কাছে অনুরোধ করবো যে, আপনারা কষ্ট হলেও খামারে বাচ্চা তোলেন। অবশ্যই সুদিন আসবে। আপনারা জানেন, আপনাদের উৎপাদিত পন্যের বড় একটা অংশ চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট, ফাস্টফুডসহ বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হতো যা করোনা সংকটের কারনে বন্ধ। এমতাবস্থায়, আপনারা আশেপাশের খামারীসহ একত্রিত হয়ে যে দামে পন্য বিক্রয় করলে আপনারা টিকে থাকতে পারবেন শুধূ সে দামেই মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে বিক্রয় করুন। আর, তা না হলে আপনারা নিজেরা সম্মিলিতভাবে বিক্রয় কেন্দ্র খুলে বা মাইকিং করে ভ্যানে নিয়ে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে ডিম বা ব্রয়লার মুরগী বিক্রয় করুন। এতে, আপনারা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ভোক্তারাও তুলনামুলকভাবে কম মুল্যে পন্য কিনতে পারবেন।

৩) কৃষক ভাইবোনদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা আপনাদের উৎপাদিত শাকসব্জি আশেপাশের ৫/১০ জন মিলে একত্রে ভ্যানে করে নিকটবর্তী শহর/বাজারে নিজেরাই বিক্রয় করার ব্যবস্থা করতে পারেন। এতে, আপনারা ও ভোক্তা উভয়েই সুফল পাবেন। বোরো ফসল ঘরে তোলার সাথে সাথেই যাতে উপযোগী জমিতে আউশের চারা রোপন করতে পারেন তার জন্য এখোনি ব্যবস্থা নিতে হবে বিশেষ করে বীজতলায় চারা তৈরীর কাজ। সেইসাথে বোরো ফসল তোলার পরপরই নীচু জমিতে বোনা আমনের বীজ বুনে দিন যাতে বর্ষার পানি আসার আগেই বোনা আমন গাছ বাড়ন্ত অবস্থায় থাকে। রোপা আমন চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আগে থেকেই গ্রহন করুন। প্রয়োজনে স্থানীয় কৃষি কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় বীজ সারের ব্যাপারে পরামর্শ করুন।

৪) মৎস্য হ্যাচারী, মৎস্য খামারী, ডেইরী খামারী, ফল-ফুলসহ অন্যান্য কৃষিজ পন্য উৎপাদনকারীদের প্রতি একইরুপ অনুরোধ যে, আপনারা যার যার অবস্থান থেকে নিজেরা টিকে থাকার পাশপাশি দেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসুন।

৫) ভোক্তা শ্রেনীর সকলের প্রতি অনুরোধ, আপনারা বেশী বেশী আমিষ জাতীয় খাবার এর জন্য ব্রয়লার মুরগী, ডিম, দুধ, মাছ কিনুন। নিজেরা সুস্থ থাকুন সেইসাথে আমাদের খামারীদের টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করুন।

কথায় আছে, শিশু কান্নার মাধ্যমেই জানান দেয় যে, তার খাবার চাই। আমাদের কৃষকসহ সকল খামারীদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনাদের ন্যায্য পাওনা আপনাদেরকেই বুঝে নিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর পরই কৃষকের ন্যায্য অধিকার পাওয়ার জন্য সমবায়ের ডাক দিয়েছিলেন। তাই, আজকে আপনারা সমবায়ী হোন, একত্রিত হোন। মধ্যস্বত্বভোগীদের পরিহার করে আপনার পন্য সরাসরি ভোক্তার কাছে আনুন এবং ন্যায্য দামে বিক্রয় করে লাভবান হোন।

আশার কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে কৃষির জন্য মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ৫০০০ কোটি টাকার প্রনোদনাসহ অন্যান্য কর্মসুচীর ঘোষনা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষক ভাইবোনদের প্রতি জমির সদ্বব্যবহার পুর্বক বেশী বেশী ফসল ফলানোর জন্য আহবান জানিয়েছেন। আশা করি, কৃষক এবার ধানের ন্যায্য মুল্য পাবেন। তাই, সকল কৃষক ও খামারী ভাইবোনদের কাছে অনুরোধ জানাবো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যানে আপনাদের উৎপাদনকে অব্যাহত রাখবেন। আমরা বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানূষ যার যার অবস্থান থেকে আমাদের এই সময়ে অর্থনীতির প্রানশক্তি কৃষক ও খামারীদের সহযোগীতা ও উৎসাহ দিয়ে যাবো। আগামী আউশ ও আমন মৌসুমে যাতে আমাদের কৃষকেরা ব্যাপকভাবে ধানের চাষ অব্যাহত রাখতে পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও অধিদফতরকে এখোনি পরিকল্পনা নিতে হবে। মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য মৎস্য ও প্রানীসম্পদ মন্ত্রনালয়ের মৎস্য অধিদফতর ও প্রানীসম্পদ অধিদফতরকেও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে আমাদের কৃষকেরা গ্রীম্মকালীন সব্জি যেভাবে চাষ করেছেন তাতে বিশ্বাস করি বাজারে শাকসব্জির সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।

এভাবেই, সকলে সম্মিলিতভাবে সকল কৃষিজ পন্য উৎপাদক ও সরকারের হাতকে শক্তিশালী করে করোনাকে জয় করবোই এবং এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। পরম করুনাময় আল্লাহতালা আমাদের সহায় হউন।