মির্জাপুর প্রতিনিধি :
মাসুদের যে কথার উপর ভিত্তি করে সমাজচ্যুত করা হয় জুয়েলকে –
ঝগড়ার একপর্যায়ে একই গ্রামের শামসুল হকের ছেলে মাসুদ জুয়েলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তুই খ্রীষ্টান কলেজে (ঢাকার নটরডেম কলেজ) লেখাপড়া করেছিস। এছাড়া তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় লেখাপড়া করেছিস। নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বাংলায় লেখাপড়া করে তারা নাস্তিক। তুইও নাস্তিক।” নাস্তিকের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুমকি দেন। এছাড়া জুয়েলের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেন সেসময়।
শুধু তাই নয়, ওই পরিবারের কেউ সমাজের অন্য কোন লোকের সাথে মেলামেশা করার চেষ্টা করলে তাদের বাড়িঘরও ভেঙে এলাকা ছাড়া করার হুমকিও দেয়া হয়েছে।
এছাড়া গত ঈদুল আযহায় ওই পরিবারটিকে সামাজিকভাবে কোরবানিতেও অংশ নিতে দেয়নি।
অমানবিক এ ঘটনাটি ঘটেছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার তারফপুর ইউনিয়নের পাথালিয়াপাড়া গ্রামে।
জুয়েল খান উপজেলার তরফপুর পাথালিয়াপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে।
সে নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর ৪০তম বিসিএস-এ লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।
এ ঘটনায় উভয়পক্ষই থানায় ও কোর্টে মামলা করেছেন বলে জানা গেছে।
তরফপুর পাথালিয়া পাড়া গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে ঘটনার বিবরণে যা জানা গেল
বাড়ির সীমানা নিয়ে জুয়েল খানের পরিবারের সঙ্গে চাচাতো ভাই আবদুর রশিদ খানের ছেলে শরিফুল ইসলামের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে।
এই বিরোধের জের ধরে গত পহেলা মে শরিফুল ইসলামের লোকজন লাঠিসোটা ও লোহার রড নিয়ে জুয়েলদের বাড়িতে এসে পরিবারের সদস্যদের মারপিট করে।
এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন শরিফুল ইসলাম, আবদুল বাছেদ মিয়া, রমজান আলী, আবদুল লতিফ, তারিকুল ইসলাম ও লিটু আনাম।
এ সময় একই গ্রামের শামসুল হকের ছেলে মাসুদ জুয়েলকে উদ্দেশ্য করে বলেন তুই খ্রীষ্টান কলেজে (ঢাকার নটরডেম কলেজ) লেখাপড়া করেছিস। এছাড়া তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় লেখাপড়া করেছিস। নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বাংলায় লেখাপড়া করে তারা নাস্তিক। তুইও নাস্তিক। নাস্তিকের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুমকি দেন। এছাড়া জুয়েলের পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেন তারা।
জুয়েল ও তার ভাই মারুফ খান এসব কথার প্রতিবাদ করে।
সেসময় রফিকুল ইসলাম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা জুয়েল ও তার বৃদ্ধ বাবা মফিজুল ইসলাম, মা আমেনা বেগম, নানী ইয়ারন বেগম, ভাই মারুফ খানকে এলোপাথারি মারপিট করে আহত করে।
এ সময় তাদের লাঠির বারিতে জুয়েলের বৃদ্ধা নানী ইয়ারন বেগমের ডান হাতের পাখনার হাড় ভেঙে যায়।
তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আহতদের উদ্ধার করে উপজেলাস্থ জামুর্কী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
এই ঘটনার পর থেকে ওই পরিবারটিকে সমাজচ্যুত করে রাখা হয়েছে।
গত ঈদুল আযহায় পরিবারটিকে সামাজিক কুরবানিতেও অংশ নিতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওই সমাজের কেউ জুয়েলের পরিবারের সাথে মেলামেশা করার চেষ্টা করলে তাদের বাড়িঘরও ভেঙে এলাকা ছাড়া করার হুমকিও দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ অমানবিক ঘটনার পরও জুয়েলের পরিবারের বিরুদ্ধে উল্টো মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করা হচ্ছে বলে জুয়েলের মা আমেনা বেগম জানিয়েছেন।
গ্রামবাসী ও পুলিশ যা বলছে
তরফপুর গ্রামের বাসিন্দা স্বাস্থ্যকর্মী মাহমুদুল হাসান বলেন, জুয়েলের পরিবার সমাজের কাউকে মানে না।
তাছাড়া জুয়েলের বাবা মসজিদ সম্পর্কে কটাক্ষ করে কথা বলে এবং মসজিদে তাদের নির্ধারিত হারে ধরা অনুদানের টাকাও তারা দেয় না।
যে কারণে সমাজের মুরুব্বিরা তাদের সমাজচ্যুত রাখার কথা বলেছিলেন।
একই গ্রামের আরিফুল ইসলাম ইসলাম বলেন, জুয়েলের পরিবারকে সমাজচ্যুত রাখতে শরিফুলের সমাজের লোকজন সকলের স্বাক্ষরও নিয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন বলে জানান।
তরফপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল বাসেদ মিয়া বলেন, দুই পরিবারের বিরোধ মীমাংসা করতে গিয়ে আমরা মামলার আসামী হয়েছি।
তরফপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার ওয়াহিদুর রহমান ফেরদৌস বলেন, ১৩ পরিবার নিয়ে তাদের একটি সমাজ।
কেউ কেউ বলছেন সমাজের ভাঙ্গুনী (ইমামের বেতন) দেয় না বলে সমাজচ্যুত রাখা হয়েছে।
আবার কেউ কেউ বলছেন জুয়েলের দাদীকে সমাজে রাখার কারণে জুয়েলের বাবা সমাজে থাকবেন না।
আমরা গ্রামবাসী উভয়পক্ষের সাথে আপোষের চেষ্টা করছি।
মির্জাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, জুয়েল খান নটরডেম কলেজে লেখাপড়া করার কারণে গ্রামের কতিপয় মাতাব্বর তাকে খ্রীষ্টান অপবাদ দিয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।
মিজাপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সায়েদুর রহমান বলেন –
গ্রামের কয়েকজন মাতাব্বর জুয়েলের পরিবারকে খ্রীষ্টান অপবাদ দিয়ে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেয়। বিষয়টি খুবই অমানবিক।
পুলিশি তদন্তে এর সত্যতা রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।