বিশেষ প্রতিবেদক : টাঙ্গাইলের গোপালপুরে রাইস মিলে তিন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও দায় নেই মিল কর্তৃপক্ষের।
তবে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
তবে মালিক পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ পেতে নিহতের স্বজনদের অপেক্ষা করতে হবে সপ্তাহখানেক।
এদিকে জেলার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কর্মকর্তারা এবং ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিক তদন্তে একতা এগ্রোফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের রাইস মিলে নতুন হুপার নির্মাণে ত্রুটি ও ধারন ক্ষমতার থেকে অতিরিক্ত ওজন এবং কর্তৃপক্ষের গাফিলতির তথ্য পেয়েছে।
এরআগে ৪ সেপ্টেম্বর রাতে গোপালপুর পৌরসভার ডুবাইলে অবস্থিত একতা এগ্রোফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের রাইস মিলে নির্মিত নতুন হুপার ধসে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
নিহত শ্রমিকরা হলেন- কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়ার ছেলে আরিফ (২০), একই জেলার গারুহাড়া গ্রামের করিম মোল্লার ছেলে নুরুল ইসলাম (৩৫) ও নুর মোহাম্মদের ছেলে নাঈমুল ইসলাম (৩৩)।
এই ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল হোসেনকে।
কমিটির অপর সদস্যরা হলেন গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ মল্লিক, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন, গণপূর্ত বিভাগ, কলকারখানা পরিদর্শন কর্মকর্তা ও ফায়ার সার্ভিসের একজন করে প্রতিনিধি।
ঘটনার বিস্তারিত –
সরেজমিনে একতা এগ্রোফুড প্রোডাক্টসে গিয়ে দেখা গেছে, যে ঘরটিতে দূর্ঘটনা ঘটেছে সেটি তারা দিয়ে রেখেছে মিল কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া মিলে প্রবেশাধিকারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সাংবাদিকদেরকেও ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
তবে সেখানে মালিক পক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত রাইস মিলের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এই ঘটনায় শ্রমিকদের স্বজনদের পক্ষ থেকে কোন অভিযোগ না থাকায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নিহত শ্রমিকদের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে রাতে তাদের স্বজন কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ।
পরে সোমবার রাতেই একটি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাদের নেয়া যায় হয় কুড়িগ্রাম শ্রমিকদের গ্রামের বাড়িতে।
বাড়িতে লাশ পৌছালে সেখানে স্বজনদের কান্নার আহাজারি শুরু হয়।
সেদিন রাতে কি ঘটে ছিল জানতে চাইলে শ্রমিকরা জানান, মিলের যে হুপারটি ভেঙে পড়েছে সেটি তার আগেরদিন নির্মাণ করা হয়েছে।
কতটুকু হুপারটির ধারণ ক্ষমতা ছিল সেটা না জেনেই কাজ শুরু করা হয়েছিল।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই হুপারে বেশি ওজনের চাল হওয়ায় সেটি ধসে পড়ে সেখানে থাকা শ্রমিকদের উপর।
ফলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাদের। ওই রাইস মিলটিতে ধান ও চাল মিলিয়ে দুইটি সেকশনে অর্ধশত শ্রমিক কাজ করে।
শ্রমিকদের বক্তব্য –
শ্রমিক আল আমিন বলেন, রাইস মিলে আগের দুইটি হুপার ছিল। কর্তৃপক্ষ আরো একটি হুপার নির্মাণ করে।
সেটি রবিবার দিনই উদ্বোধন করা হয়। নতুন হুপারটিতে ২৫০ বস্তা চাল ছিল। বেশি ওজন হওয়ায় সেটি ভেঙে পড়েছে।
সেখানে নাজমুল ও মজনু নামের দুই ভাই শ্রমিকের কাজ করতো। কিন্তু ঘটনার সময় মজনু মিলের বাইরে ছিল বিধায় সে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক বলেন, রাতে ওই তিন শ্রমিক তাদের কাজ আগে শেষ করতে গিয়েছিল।
এসময় ঘরের ভিতর বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে দৌড়ে গিয়ে মেইন সুইচ বন্ধ করে দেয়া হয়। ধারণা করা হয়েছিল হয়ত আগুন লেগেছে।
পরে ঘরে গিয়ে দেখি হুপার ভেঙে শ্রমিকদের উপর পড়ে আছে। পরে পুলিশ, ফায়ারসার্ভিস ও স্থানীয় তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে।
নিহতের স্বজনরা জানান, অভিযোগ করে কি হবে তাদের তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এছাড়া কুড়িগ্রাম থেকে টাঙ্গাইল গিয়ে মামলা চালানো সম্ভব না।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে আর্থিক সহায়তা পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত মালিক পক্ষ থেকে কোন আর্থিক সহায়তা করা হয়নি।
তবে মালিক পক্ষ থেকে আশ^াস দেয়া হয়েছে শ্রমিকদের জনপ্রতি ২ লাখ টাকা করে দেয়া হবে। কিন্তু সেটা এক সপ্তাহের সময় চেয়েছে তারা।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য –
একতা এগ্রোফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড রাইসমিলের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. উজ্জল বলেন, এটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা।
নিয়ম মেনেই হুপারটি নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। রাইস মিল চলার সাপেক্ষে একটু সমস্যাতো হতে পারে।
শ্রমিকদের ভুলের কারণেও এটা হতে পারে। নিহতদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে।
গোপালপুর ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ইনচার্জ নুরুল ইসলাম বলেন, একতা রাইসমিলের হুপারটির ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ওজনের চাল দেওয়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
হুপারটি ঝালাই কাজ সঠিকভাবে করা হয়নি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই চালু করা হয়েছিল।
টাঙ্গাইলের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (সেফটি) মো. ফারুক হোসাইন বলেন, রাইস মিলটিতে সেফটির বিষয়টি ঘাটতি ছিল।
হুপারটির নির্মাণ কাজের ত্রুটি ছিল। সেটি যথেষ্ট শক্ত করে নির্মাণ করা হয়নি। হুপারটি বেশি পরিমাণের ওজন বহনের ক্ষমতা ছিল না। এরপরও আরো যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির সদস্য মো. পারভেজ মল্লিক বলেন, এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সেখানে আমিও একজন সদস্য। আগামী দুই তিনদিনের মধ্যে কমিটির সদস্যরা একতা রাইস মিলটি পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করবে। সম্পাদনা – অলক কুমার