বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। তখন জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্থাপিত “বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর” ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় ৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক, সাবেক পৌর মেয়র জামিলুর রহমান খান মিরন এবং ওই দিন রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের এর বাড়ি মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি ও তার অনুসারীরা ভাঙচুর করে। এ সময় বাড়িগুলোতে লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। এই ভাঙচুরে নেতৃত্বে দেন মিষ্টি। তিনি ক্ষোভ এবং প্রতিহিংসাবশত ভাঙচুর ও দখল কার্যক্রম চালিয়েছেন বলে রিমান্ডে স্বীকার করেছেন। এর আগে তিনি এই কথা গণমাধ্যমের কাছেও স্বীকার করেন। সেসময় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর দখল করে বৃদ্ধাশ্রম, পাগলের আশ্রম, এতিমখানা করা হবে বলে জানিয়েছিলেন মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি।
গত ৮ মার্চ শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় জোয়াহেরুল ইসলামের বাড়ির তালা ভেঙে দখলে নেন মারইয়াম। সেখানে ১৭ জন মানসিক ভারসাম্যহীন নারী-পুরুষকে উঠিয়ে দিয়ে বাড়িতে ‘পাগলের আশ্রম’ চালুর ঘোষণা দেন। পরে রাতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে বাড়িটি খালি করেন। পরে প্রশাসনের কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান মারইয়াম। এ ঘটনায় ৯ মার্চ রাতে জোয়াহেরুল ইসলামের স্ত্রী বাদী হয়ে মারইয়ামের বিরুদ্ধে মামলা করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
রিমান্ডে মিষ্টি যা বলেন –
২০২০ সালের আগে একটি আশ্রম তৈরির উদ্যোগ নেন ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দেওয়া মারইয়াম মুকাদ্দাস মিষ্টি। সেই সময় তিনি বিট কয়েনের ব্যবসা করতেন, যা বাংলাদেশে অবৈধ এবং তার একাউন্টে অনেক টাকা ছিলো। টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা তানভীর হাসান ছোট মনির ও টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান মিরনের নেতৃত্বে তার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। সেই কাজে সার্বিক প্রশাসনিক সহায়তা করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক এড. জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের। সেই রাগের বশবর্তী হয়ে ৫ আগস্টের পর প্রতিশোধ নিতে সুযোগ বুঝে তাদের বাড়ি ভাঙচুর চালায় বলে চার দিনের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন মিষ্টি। তবে তিনি কোনো উগ্রবাদী ও বিদেশী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলেও জানিয়েছেন রিমান্ডে।
চার দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মারইয়াম মুকাদ্দাসকে টাঙ্গাইল সদর আমলি আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আরও পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. গোলাম মাহবুব খাঁন তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে মারইয়ামের পক্ষে শুনানিতে অংশ নিয়ে আইনজীবীরা তাঁর জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন। মারইয়াম মুকাদ্দাসের বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকী ইউনিয়নের যশিহাটী দোহার গ্রামে। ওই গ্রামের মাজহারুল ইসলামের মেয়ে তিনি। প্রতিবেশীরা জানান, মারইয়াম মুকাদ্দাস গ্রামে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। তারপর ঢাকায় চলে যায়। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ চাইলে তা দিতে পারেন নি মিষ্টি।
পুলিশ যা বলে –
পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানতে পেরেছেন, মারইয়াম ঢাকায় গিয়ে একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইনে স্নাতকে ভর্তি হলেও শেষ করতে পারেননি। মারইয়াম বিভিন্ন সময় সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতের কাশ্মীরসহ একাধিক দেশ সফর করেছেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে ব্যাপক পরিচিতি পান। সেই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জেলা ও পুলিশ প্রশাসনেও গুরুত্ব পেতে শুরু করেন।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানবীর আহম্মদ বলেন, সাবেক সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলামের বাড়ি দখল, চাঁদা দাবির উদ্দেশ্য, বিদেশ গমনের কারণসহ বিভিন্ন তথ্য জানতে তাঁকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আবার রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।