অনলাইন ডেস্ক: পড়ালেখা শেষ করার আগেই বিয়ে, তারপর ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোমের মতো সারাক্ষণ ক্লান্তি লেগে থাকার রোগ, জিমে হেনস্থা, ক্যারিয়ারের শুরুতে নিদারুণ ব্যর্থতা। বাংলাদেশি-ব্রিটিশ তরুণী রুকসানা বেগম এসব জয় করে ওয়ার্ল্ড কিক বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের (৪৮ কেজি ওজনশ্রেণি) বিশ্ব খেতাব জিতেছেন সেই চার বছর আগে। এতদিন বাদে নিজের ফেলে আসা এই লড়াইয়ের গল্প শুনিয়েছেন দ্য গার্ডিয়ানকে।
২০১০ সাল থেকে ব্রিটিশ মুয়ে থাই (কিক বক্সিংয়ের একটি বিশেষ ধরন) শিরোপা টানা ধরে রাখা রুকসানার সেটাই ছিল প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব জয়। প্রায় চার বছর ধরে ব্রিটিশ জাতীয় মুয়ে থাই দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা রুকসানা ২০১৩ ও ২০১৫ সালেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাবের জন্য লড়েছিলেন।
বুধবার গার্ডিয়ানে বড় একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে রুকসানার। নতুন একটি বই লেখার পর তাকে নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
ইস্ট লন্ডনে জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশি তরুণী রুকসানা তার পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম। পারিবারিক আয়োজনে তার বিয়ে হয়েছিল।
বাংলাদেশে তাদের আদি বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে। ১৬ বছর বয়সে সর্বশেষ দেশে আসেন। পেশায় কিক বক্সার হলেও রুকসানা পড়াশোনা করেছেন স্থাপত্য বিষয়ে।
বেথনাল গ্রিনে বসে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় থেকে-থেকে চোখের পানি ফেলছিলেন রুকসানা। অতীতের কথা স্মরণ করে চোখ মুছে ৩৬ বছর বয়সী রুকসানা গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘ওই মুহূর্তগুলো আমাকে এখানে এনেছে।’
‘বর্ন ফাইটার’ বইয়েও রুকসানা লড়াই আর বাধার গল্প তুলে ধরেছেন।
’২৩ বছর বয়সে আমার বিয়ে ঠিক হয়। লোকটাকে আমি চিনতামও না। খুব ভয় পেয়ে যাই। মাকে সব খুলে বলি। কিন্তু আমাকে জানিয়ে দেন, সব ঠিক হয়ে গেছে।’
রুকসানার স্বামী ইস্ট লন্ডনের ব্যাংকার ছিলেন। জোর করেই তার সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়, ‘আমি হতাশ হয়ে পড়ি। সংসারের কাজ করতে করতে কাউকে বলতেও পারতাম না যে আমি ক্লান্ত। সব সময় তাদের খুশি করে চলতে হতো।’
অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে কয়েক মাসের ভেতর রুকসানার প্যানিক অ্যাটাক হয়। কারণে-অকারণে আতঙ্কগ্রস্ত হতে থাকেন। তখন চিকিৎসক তাকে বাবার বাড়িতে ফেরার পরামর্শ দেন।
‘আমি ফিরে আসি। বাবা আমাকে নিয়ে দোটানায় পড়েন। মা-ভাই বলছিল ফিরে যেতে হবে। এটাই নাকি ঐতিহ্য। একবার থেরাপির সময় বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া ভালো ছিল না।’
‘এর ভেতর আমার স্বামী ডিভোর্স পাঠায়। তখন মনে হয়েছিল, আল্লাহ এটাই আমার মুক্তি। এরপর মা-বাবা আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারেন।’
এক সময় মা-বাবাকে বুঝিয়ে বক্সিংয়ে ফেরেন। শুরু করেন জিম। কিন্তু সেখানে আবার আরেক নারী ফাইটার তার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন। কোনো কারণ ছাড়াই ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির রুকসানাকে তিনি হেনস্তা করতে থাকেন।’
রুকসানা সবাইকে চমকে দেন ২০১১ সালে। নিজের কর্নারে কাউকে ছাড়াই সেবার ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হন। কয়েক রাউন্ড হওয়ার পর এক ড্যানিশ ট্রেইনার বুঝতে পারেন, রুকসানা চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছেন, তখন তিনি কর্নারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
পাঁচ বছর বাদে লন্ডনের দ্য রাউন্ড চাপেল মিলনায়তনে রুকসানা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাড়ি ফেরেন। সেদিন রাতে মা-বাবাকে ডেকে ওঠান। তার বাবা বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে মেয়ের জয় উদযাপন করতে চলে যান। কিন্তু সকালে ঘটে আরেক ঘটনা।
‘ঘুম থেকে ওঠার পর কিছুটা অসুস্থ ছিলাম। উঠেই বাবার কাছে যাই দোয়া নিতে। কিন্তু উনি আমাকে বুঝতেই দেননি যে আমার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খবর শুনেছেন।’
রুকসানার বাবা সকালে নিজেকে সামলে রাখলেও পরদিন রাতে আর ধরে রাখতে পারেননি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে উল্লাসে মাতেন। আর মা?
অনেক জোরে জড়িয়ে ধরেছিলেন…
সোনালী/এমই