বিশেষ প্রতিবেদক : ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত হয়। উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
তৎকালীন তরুণ ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত কাদেরিয়া বাহিনীর বীরত্বের কথা দেশের প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে বাঘা সিদ্দিকী নামে পরিচিতি পায়।
আর সেই বাঘা সিদ্দিকী ও তাঁর গঠিত কাদেরিয়া বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় আছে।
কাদেরিয়া বাহিনীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি এবং তার দোসর হানাদার ও রাজাকার বাহিনীর সাথে অনেক সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে যে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে দেশের মুক্তি পাগল দামাল ছেলেরা।
তৎকালীন প্রেক্ষাপট –
কাদেরিয়া বাহিনী সখীপুরের বহেড়াতৈলে অবস্থান করে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
২৬ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল ছিল স্বাধীন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রশাসন পরিচালিত হয়।
২৬ মার্চ সকালে আদালত পাড়ার অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামের বাসভবনে এক সভায় টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হয়।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আহবায়ক ও সশস্ত্র গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং বদিউজ্জামান খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল কাদের সিদ্দিকী সহ আরও ৮ জনকে সদস্য করে কমিটি গঠিত হয়।
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল মান্নান, গণপরিষদ সদস্য শামসুর রহমান খান শাজাহান, আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন অগ্রগণ্য।
ক্রমান্বয়ে সংগঠিত হতে থাকে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩ এপ্রিল বিকালে টাঙ্গাইল শহর দখল করে নেয়।
টাঙ্গাইলের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পুরো বাহিনী টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এলাকা সখীপুরের বহেড়াতৈলে চলে যান।
সেখানে এ বাহিনীর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এবং রিক্রুট ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পরবর্তীকালে এ বাহিনীরই নাম হয় কাদেরিয়া বাহিনী।
এ বাহিনীর প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজার।
এছাড়া ৭০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও কাদেরিয়া বাহিনীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
কয়েকটি যুদ্ধ –
১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রায় পাঁচ হাজার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং ৭ হাজার রাজাকার-আলবদর টাঙ্গাইলে অবস্থান করে।
এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের ৮ তারিখ পর্যন্ত টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পরাজিত করে খান সেনাদের।
এসব যুদ্ধে তিন শতাধিক দেশপ্রেমিক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়।
কালিহাতীর পুংলি ব্রিজের পাশে মিত্র বাহিনীর ছত্রী সেনা অবতরণ করলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়।
অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণভয়ে হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল ছেড়ে ঢাকার দিকে পালায়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী চারদিক থেকে সাড়াশী আক্রমণ চালিয়ে হানাদারদের টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় কাদেরিয়া বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর রাতে টাঙ্গাইল প্রবেশ করেন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভোলা।
১০ ডিসেম্বর রাতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইল সদর থানা দখল করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
১১ ডিসেম্বর ভোরে কমান্ডার বায়োজিদ, খন্দকার আনোয়ার ও বিগ্রেডিয়ার ফজলুর রহমান টাঙ্গাইল পৌঁছান।
১১ ডিসেম্বর ভোরে কাদেরিয়া বাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে দখলে নেয়।
সার্কিট হাউজ দখলে নেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে এবং সারা শহর নিজেদের দখলে নিয়ে হানাদারদের ধরতে থাকেন।
এভাবেই টাঙ্গাইল শহর সম্পূর্ণ হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তির স্বাদ পেয়ে উল্লসিত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং শহরকে শত্রুমুক্ত করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।
হানাদার বাহিনীর দোসর স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধ চালাকালে অসংখ্য মুক্তিকামী নারী-পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যেত।
সেখানে তাদের পৈচাশিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। পাকিস্থানাী হানাদার বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষী হয়ে আছে এ সব বধ্যভূমি ও গনকবরগুলো।