দু’হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।
বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় তৃতীয় স্থানে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম। আজ তাঁর জীবন-কথা।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে।
তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারের দুখু মিয়া হয়ে। আর মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মাঝে ৭৭ বছর জুড়ে ছিল সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস।
দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘বল বীর বল উন্নত মম শির,…যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না -বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত!’
কবি নজরুল ইসলাম সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল – ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’
পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয় ১৮৯৯ সালের ২৫শে মে।
বাবা ছিলেন কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহিদা খাতুন। বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। তাঁর ভবঘুরে বাল্যকাল আর তাঁর স্কুল শিক্ষা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে।
অল্প বয়সে স্থানীয় মসজিদে তিনি মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন। কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক দলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে বাল্যকালে খানসামা ও চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করেছেন।
তবে নজরুল গবেষক জিয়াদ আলি বিবিসি বাংলাকে বলেন, তরুণ বয়সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন নজরুল ।
“করাচিতে গিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। ১৯২০ সালে তিনি যখন কলকাতা ফিরে গেলেন, তখন কিন্তু তাঁর মূল স্বপ্নই ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। তিনি বহু লেখায় বলেছেন সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সেনাবাহিনীর কাজ শেষ করে কলকাতায় ফেরার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন ‘বিদ্রোহী’ এবং ‘ভাঙার গানের’ মতো কবিতা এবং ধূমকেতুর মতো
তবে নজরুল ইসলামের নাতি সাগর কাজী বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, তার বন্ধুবান্ধবরা নজরুল ইসলামকে মনের মন্দিরে বসিয়ে রেখেছেন। তারা মনে করেন নজরুল তাদের জন্য একজন পথের দিশারী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন ‘ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র’ হিসাবে। অনেক বিশ্লেষক বলেন তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাঁকে অমর করে রেখেছে।
নজরুলের প্রতিভার যে দিকটা ছিল অনন্য সেটা হল তাঁর বিদ্রোহী চেতনার বহি:প্রকাশ- সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সব কিছুর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহে তিনি সোচ্চার হয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সঙ্গীতে।
গবেষক জিয়াদ আলি বলেছেন তিনি কিন্তু শুধু কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মীও।
“কখনও তিনি গান গাইছেন, কখনও পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, কখনও রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। নজরুল সম্ভবত ওই সময়ের প্রথম বাঙালি, যিনি বাংলার নবজাগরণের যে ঐতিহ্য সেটা ধারণ করেছিলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে তিনি বাঙালিকে একটা শক্ত, সবল নতুন চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।”
কলকাতায় অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবন তাঁর সাহিত্যে বড়ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
“নজরুল উঠে এসেছিলেন সমাজের অতি পেছিয়ে থাকা শ্রেণি থেকে। শুধু দারিদ্রই নয়, শিক্ষার অভাবের মধ্যে দিয়ে তিনি বড় হয়েছিলেন- প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন কেটেছিল।”
নজরুল সম্পর্কে একাধিক গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক মুস্তফা নুরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, প্রতিকূলতায় ভরা ওই জীবনের মধ্যে দিয়েই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল।
“তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ ছিলেন নজরুল। যে পথ দিয়ে তিনি গেছেন, যে প্রকৃতিতে তিনি লালিত হয়েছেন, যে পারিপার্শ্বিকতায় তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেগুলো তাঁর অজান্তেই তাঁর ওপরে ছাপ ফেলে গেছে। তারই বহি:প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে ও কবিতায়।”
সাময়িকী।
জাতীয়তবাদী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য বহুবার কারাবন্দী হয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। জেলে বন্দী অবস্থায় লিখেছিলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। তাঁর এইসব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল প্রকট।
সাংবাদিকতার মাধ্যমে এবং পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যকর্মে নজরুল শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
চুরুলিয়ায় কবি নজরুল ইসলামের জন্মভিটা যা এখন নজরুল অ্যাকাডেমি, তার পাশেই এই অনুষ্ঠান তৈরির সময় থাকতেন কবির এক ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী মাজহার হোসেন, যিনি সেসময় ছিলেন অ্যাকাডেমির সাধারণ সম্পাদক।
“নজরুল ছিলেন সব ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে। অন্তরে তিনি না ছিলেন হিন্দু না ছিলেন মুসলিম। তাঁর একটি কথাতেই এটা ছিল পরিষ্কার- ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’। তিনি সবার ঊর্ধ্বে ছিলেন মানবতার কবি। গোটা ভারতবর্ষেই তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি।”
সূত্র: bbc.com