টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবালিয়া এলাকায় অনুমোদন ছাড়া বিশাল বহুতল ভবন একতা টাওয়ার এখন একটি পরিপূর্ণ স্থাপনা। বহু অনিয়ম, অভিযোগ, আইন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবশেষে একতা টাওয়ারের নির্মাণ কাজ সমাপ্তির দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে এর নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটটি টাঙ্গাইলের বর্তমানে বহুতল ভবন নির্মাণের সবচেয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যারা কোন কিছুই তোয়াক্কা করে না বলে শত শত অভিযোগ আছে।
জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই সিন্ডিকেটটি তৈরি হয়। তখনকার টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এস এম সিরাজুল হক আলমগীরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সিন্ডিকেটটি টাঙ্গাইলের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ হাতে নেয়। সেখানে অনিয়মের পাশাপাশি সরকারি খাস জমিও দখল করে ভবন তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি করে। সেই টাকার বড় একটি অংশ সাবেক মেয়র সিরাজুল হক আলমগীরের পকেটে গেছে বলেও নিশ্চিত করেছেন পৌরসভার একটি সূত্র।
সূত্রটি আরও জানানয়, সাবেক মেয়রের সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকলেও টাঙ্গাইল পৌর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব ও টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান (ছোট মনি) এর বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া (বড় মনি) কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে এই ঝূকিপূর্ণ ভবনটি করার জন্য সকল বন্দোবস্ত করে দেন।
৫ আগস্টের পর সিন্ডিকেটটি বিএনপি ও জামায়াত ঘণিষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির একাধিক নেতা ও কেন্দ্রীয় ২/১ জন নেতার অতি ঘণিষ্ট বলে পরিচয় দেয় ও তা চাউর করে বেড়ায়।
তবে ভবনটির কাজের শুরুতে সকল অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অভিযোগ, দুর্নীতি ও বহুতল ভবন নির্মাণের আইন অমান্যের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলেও কোন এক অজানা কারণে এগুলো বন্ধ করেনি পৌর কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন। একতা টাওয়ার এপর্যন্ত প্রায় অনুমোদন ও নকশা বহির্ভূতভাবে প্রায় ৫০ হাজার স্কয়ার ফিট অতিরিক্ত কাজ করেছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা লিখিতভাবে অভিযোগ দিয়েছেন টাঙ্গাইল পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী, জেলা প্রশাসক ও গণপূর্ত অধিদফতরের কাছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সকল বিষয়ে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন তার কোনটি এই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়নি।
অভিযোগে যা উল্লেখ –
২১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে দাখিল করা অভিযোগপত্রে বলা হয়, পৌর এলাকার সাবালিয়ায় ময়মনসিংহ রোডের পাশে “একতা টাওয়ার” নামের ভবনটির নির্মাণ কাজ চলছে। অভিযোগকারীদের দাবি, ভবনের মালিক কোনো অনুমোদিত নকশা ছাড়াই অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করছেন। এতে আশপাশের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও নিকটবর্তী অন্য ভবনগুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। এছাড়া রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন সব সময় হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে। টাঙ্গাইলের প্রধান সড়ক গুলোর মধ্যে এই সড়কটি অন্যতম। টাঙ্গাইল পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, কুমুদিনী কলেজ গেট, নিরালা মোড় ও শহরের প্রায় কয়েকটি এলাকা ও অন্য জেলার গাড়ি এই ভবনের সামনের সড়ক দিয়ে চলাচল করে থাকে। এছাড়া ভবনের কাজ সম্পুর্র্ণ না করে প্রথম ৫ তলায় পপুলার হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। হাসপাতালটিতে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী থাকে ও স্টাফরা রয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ভবন নির্মাণের সময় টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হক আলমগীর ও টাঙ্গাইল পৌর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব ও টাঙ্গাইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের বড় ভাই গোলাম কিবরিয়া ওরফে বড় মনি কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে এই ঝ‚কিপূর্ণ ভবনটি করার জন্য সকল বন্দোবস্ত করে দেন।
অভিযোগে আরো বলা হয়, বিষয়টি এর আগে পৌরসভায় জানানো হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে এলাকাবাসী আবারও লিখিতভাবে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ভূক্তভোগীদের বক্তব্য –
সেবা নিতে আসা কয়েকজন রোগী বলেন, আমরা জানতাম না যে এই ভবন এতো ঝুকিপূর্ণ, এখন তো মনে হচ্ছে মাথার উপর মৃত্যু নিয়ে এসেছি। কখন ভেঙ্গে পড়ে জানা নাই।
স্থানীয় বাসিন্দা মহরম আলী বলেন, “প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নির্মাণ কাজের আওয়াজে এলাকায় শান্তি নেই। পাইলিংয়ের সময় আমাদের বাড়ির দেয়াল ও মেঝেতে ফাটল ধরেছে। আমরা ভয়ে আছি, বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।”
আরেক বাসিন্দা ওমর আলী বলেন, “আমরা কয়েকবার পৌরসভায় গিয়েছি, কর্মকর্তাদের জানিয়েছি, কিন্তু কেউ এসে দেখেনি। যেভাবে ভবনটি উঠছে, তাতে মনে হয় প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।”
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মো. সিদ্দিক হোসেন জানান, “এই এলাকায় এত বড় ভবন আগে কখনও হয়নি। এটি যদি নিয়ম মেনে তৈরি না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ঝড়-বৃষ্টিতে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পৌর কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।”
আরেক ভূক্তভোগী হিরণ মিয়া বলেন, “আমাদের এলাকাটি মূলত আবাসিক। কিন্তু এখানে বাণিজ্যিকভাবে টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে রাস্তা সরু হয়ে গেছে, এর আগে এই ভবন থেকে ইট পড়ে এক স্কুল ছাত্র আহত হয়েছিলো এবং চলাচলে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ হচ্ছে।” এসময় তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে যেটা কথা, সেটা হলো- “আইন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে একতা টাওয়ার।” এখন আমাদের ভোগান্তির শুরু হলো।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের বলেন, “একতা টাওয়ার নির্মাণের কারণে আশেপাশের দোকানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধুলাবালি ও শব্দ দূষণে ব্যবসা চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়েছে।”
শাহেদ নামে অপর একজন ভূক্তভোগী বলেন, আমরা সাবালিয়া এলাকাবাসী বার বার প্রশাসনকে বলেছি। কিন্তু কেউ কোন কর্ণপাত করে নাই। এই ভবন আইনের কোন তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছে মতো তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজ সচেতনদের কথা –
টাঙ্গাইল জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ফাতেমা রহমান বীথি বলেন, যদি আইনের বাহিরে হয়ে থাকে তাহলে যারা অনুমোদন দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করা প্রয়োজন। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মানুষের সেবা প্রদানের জন্য, কিন্তু সেটি যদি মানুষকে ঝুঁকির মুখে পড়ে থাকে তবে তা উদ্বেগজনক। আমরা চিকিৎসা সেবার বিরুদ্ধে নই, আমরা চাই যদি বিল্ডিং পরিকল্পনার বাইরে অতিরিক্ত ভবন নির্মাণ হয়ে থাকে তবে কর্তৃপক্ষ যাতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
টাঙ্গাইল জেলা মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আতাউর রহমান আজাদ বলেন, শহরে অনুমোদনবিহীন যে সমস্ত ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে সে সমস্ত অবৈধ ভবনের কারণে আশাপাশে মানুষও ঝুঁকিতে রয়েছে। অনেকে ৩ থেকে ৪ তলা ভবন প্লান পাশ করে ৭ থেকে ৮ তলা ভবন নির্মাণ করছে তাদের বিরুদ্ধে পৌর প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া অনেক ফুটপাত ঘরে উঠছে সেগুলো উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কথা –
এবিষয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার নগর পরিকল্পবিদ মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, একতা টাওয়ারের বিষয়ে সাবেক মেয়র সিরাজুল হক আলমগীর অনুমোদন দিয়েছে। যার ফলে টাঙ্গাইল পৌরসভা অবগত নয়। বর্তমান সময়ে একতা টাওয়ারের বিষয়ে কোন প্রকার অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তবে মেয়র সিরাজুল হক আলমগীর থাকাকালীন সময়ে একটি অভিযোগ দিয়েছিল।
টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. সিনথিয়া আজমিরী খান মহাসড়কের পাশে ১০ মিটার রেখে স্থাপনা নির্মাণের বিধানটি মেনে অনুমোদন দেয়া, তদারকি করা ও নির্মাণকারীদের আইনটি মেনে চলার অনুরোধ করেছেন।
অভিযুক্ত ভবন মালিক পক্ষের প্রফেসর আব্দুল লতিফ বলেন, আমরা আইন অনুযায়ী এই ভবন নির্মাণ করেছি, যে অভিযোগ করেছে তা মিথ্যা অভিযোগ। নকশার বাহিরে কোন অতিরিক্ত নির্মাণ করা হয়নি। এছাড়া জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ১৫ তলা অনুমোদন ও পৌর প্রশাসন থেকে ৩ তলা এই ১৮ তলা ভবন করা হয়েছে। আর অভিযোগ যে কেউ করতে পারে।
এ বিষয়ে গণপূর্তের কোনো কর্মকর্তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বার বার অফিসে ও মুঠোফোনে যোগাযোগ চেষ্টা করলে পাওয়া যায়নি।
তবে স্থানীয়রা দাবি করেছেন, অবিলম্বে নকশা যাচাই ও অনুমোদনবিহীন নির্মাণ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে তারা বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবেন।










