লেখক – সানোয়ার হোসেন, মির্জাপুর : শুরুতে ৭০ ডেসিমেল জায়গার উপর নির্মিত স্কুলটির জমির পরিমান আজ ৭ একর।
তিনি পেশায় এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, শিক্ষকতার সময় তাঁর শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকতে পারত না।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেত হাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন, তাঁর ছাত্রছাত্রীরা পড়ার টেবিলে আছে, নাকি অন্য কোথাও।
তাঁর ভয়ে তখনকার শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকেরা পর্যন্ত তটস্থ থাকতেন।
শিক্ষকতা জীবনে অর্জন –
তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় ১৯৮৬-১৯৯৫ সাল পর্যন্ত থানার শ্রেষ্ঠ স্কুল, ১৯৮৭ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ স্কুল ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, ১৯৮৬-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত থানার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সম্মাননা লাভ করেন ।
১৯৮০-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত থানা শিক্ষক সমিতির বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন।
এ সময় মির্জাপুর থানার শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
শিক্ষক সমাজে প্রগাড় ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ তাঁকে ১৯৯৬ সালে স্বর্ণমুকুটে ভূষিত করা হয় ।
১৯৯৮ সালে টাঙ্গাইল জেলা গুণীজন সংবর্ধনায় তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয়।
জীবনের বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন।
সুদীর্ঘকাল তিনি মির্জাপুর ভারতেশ্বরী হোমসের গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবে এবং সাটিয়াচড়া শিবনাথ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পদ অলঙ্কিত করেন। তিনি মির্জাপুর প্রেসক্লাব ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কিংশুক প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
সেই আদর্শ শিক্ষকের নাম “দুঃখীরাম রাজবংশী”।
তিনি ছিলেন একাধারে আদর্শ শিক্ষক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সমাজ সংস্কারক এবং রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিত্ব।
জীবদ্দশায় ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালানোকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আমার নাম দুঃখীরাম। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই আমার জীবনের ব্রত।
সেই ব্রত পালনে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে গেছেন।
জন্ম ও জীবন বৃত্তান্ত –
দুঃখীরাম রাজবংশী ১৯২৪ সালের ২৫ জুন টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার নিভৃত এক গ্রাম সাটিয়াচড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
সাটিয়াচড়া গ্রামে অযোধ্যা বাবু প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ভর্তি হন জামুর্কী নবাব স্যার আব্দুল গনি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ১ম বিভাগে ১৯৪৫ সালে।
এরপর তিনি ভর্তি হন সরকারী সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এবং ১৯৪৭ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ১ম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন।
পরে তিনি সেখান থেকে ১৯৪৯ সালে ১ম বিভাগে বিএ পাশ করে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেন।
শিক্ষকতায় থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন।
কৃতিত্বের সঙ্গে বিএড কোর্স সম্পন্ন করে স্বীয় যোগ্যতা ও মেধার বলে মিরিকপুর গঙ্গাচরণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব লাভ করেন।
কর্মজীবন –
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে অমনোযোগী, দুষ্টু ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের শেষ আশ্রয় হিসেবে জামুর্কীর নওয়াব স্যার আব্দুল গণি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়ারত আলী এবং বরাটি-নরদানা বাংলাদেশ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুঃখীরাম রাজবংশীর সুনাম ছিল।
দুঃখীরাম রাজবংশীর বিপুল সংখ্যক ছাত্র একসময় দেশের উচ্চ পদে আসীন থেকে দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
দুঃখীরাম রাজবংশী মিরিকপুর গঙ্গাচরণ উচ্চ বিদ্যালয়ের ২ বছর সফলতার সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫১ সালে ২১ আগস্ট তৎকালীন বরাটি নরদানা পাকিস্তান উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমানে বরাটি নরদানা বাংলাদেশ উচ্চ বিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
এখানে তিনি সুদীর্ঘ ৪৪ বছর এই মহান পেশায় নিয়োজিত থাকার পর ১৯৯৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর অবসর গ্রহণ করেন।
৩৩ জন শিক্ষার্থী ও ৫ জন শিক্ষক নিয়ে শুরু করেন তিনি।
তিনি সেই বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান ১৫০০ শিক্ষার্থী ও ২৬ জন সুযোগ্য শিক্ষক ও স্টাফ তৈরি করে।
এটি তাঁর সফলতার উজ্জ্বল একটা উদাহরণ।
তিনি বলতেন, ‘শিক্ষকতার মহান পেশায় কেউ যদি নিজেকে নিবেদিত করতে পারেন তাহলে অজ্ঞতার আঁধার দূর হয়ে দেশ ও সমাজ হবে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত।’
পারিবারিক জীবন –
দুঃখীরাম রাজবংশী ব্যক্তি জীবনে স্ত্রী স্বর্গীয়া সুরধনি রাজবংশী, ২ ছেলে এবং ২ মেয়েসহ পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করেছেন।
সহধর্মিনী সুরধনি রাজবংশীও একজন সফল শিক্ষিকা ছিলেন।
তাঁর কীর্তি কালের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
তাঁর কীর্তি অমর করে রাখতে তাঁর হাতে গড়া বিদ্যালয়ের সামনে তাঁর নামাঙ্কিত একটি তোড়ন নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া দুঃখীরাম রাজবংশীর নাম স্মরণীয় করে রাখতে বরাটি নদীর উপর নির্মিত সেতুর নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে।
মানুষ গড়ার এ কারিগর এক সময়ের টাঙ্গাইল জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ২০০৪ সালের ২রা জানুয়ারি অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। সম্পাদনা – অলক কুমার