আহা আমার ক্যাম্পাসের বৃষ্টি
ফারহান ইশরাক, শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সকাল সাতটা। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। গত সপ্তাহ থেকে প্রতিদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বাতাসের তোড়ে বৃষ্টির পানি এসে পড়ল। চায়ের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানিও তাই হজম করতে হলো। আশপাশের রাস্তায় কেউ নেই, থাকার কথাও না। রাস্তাটা আজকাল নীরবই থাকে। অবশ্য বর্ষার দিনগুলোই এমন। বিষণ্ন, স্মৃতিকাতরতায় ভরপুর। অনেক দিন পর ছেলেবেলার মতো এ বছরের বৃষ্টির দিনগুলোও ঘরে বসেই কাটছে।
গত বছরের বর্ষাও কেটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সেবার জুন মাসে ছিল সেমিস্টার ফাইনাল। ঈদুল ফিতরের অল্প কয়েক দিন পরই তাই হলে ফিরতে হলো। তখন ক্যাম্পাস একদম ফাঁকা, দু–চারটি বিভাগ ছাড়া প্রায় সবার ঈদের ছুটি চলছে। বিশাল ক্যাম্পাসে অবসর সময়গুলো তাই একা একাই কাটত। আর সেই নির্জনতার ভিড়ে বন্ধু ছিল বর্ষার এই বৃষ্টি।
বিকেলে, সন্ধ্যায় একটু দমকা হাওয়া উঠলেই চলে যেতাম হলের ছাদে, কখনোবা মাঠে। মাঝেমধ্যে ফুলার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি নামত। আবার কোনো কোনো দিন কাটত ভীষণ ঘুমে। সকালে উঠেই দেখি বৃষ্টি, সঙ্গে ঘন কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে আবরণ চারদিকে। বিছানা ছাড়তে মন চায় না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, কিন্তু বৃষ্টি থামে না আর। ঘুম থেকে উঠে হলের দোকানে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি খেয়ে আবার ঘুমাতে যাই, শরীর-মন সারা দিন থেকে যায় অবসন্ন। ক্যাম্পাসের বর্ষার স্মৃতিগুলো এমনই। শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে বসে চা খেতে খেতে কিংবা টিএসসির মাঠে ভিজতে ভিজতে কখন যে গত বর্ষা চলে গিয়েছে টেরও পাইনি। এবারের বর্ষাটা বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
এখন একই শহরে, পাশাপাশি বাসায় থেকেও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেই। কয়েক বাসা পরেই করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে, দুশ্চিন্তাও মাথাচাড়া দিচ্ছে খুব বেশি। বদ্ধ জীবনে বই, সিনেমা আর অনলাইন আড্ডাই একমাত্র সঙ্গী। শুরুর দিকে সঙ্গটা ভালোই লাগছিল, এখন বিরক্তিকর ঠেকছে সব। এক জিনিস দীর্ঘদিন কারই বা ভালো লাগে। কিছু করারও নেই। বন্ধুদের সঙ্গে পুরোনো দিনগুলোর কথা ভেবেই তাই দিন পার করে দিই। রুটিনবিহীন হলজীবন, ক্লাস শেষে শ্যাডোর আড্ডা, ব্যস্ততম মধুর ক্যানটিনে স্লোগানে গলা মেলানো, রাতভর সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি, ঘুরেফিরে সব আলোচনারই সারবস্তু এই ক্যাম্পাসজীবন। যেখানে নিত্যদিনের বিচরণ, ভালো লাগা, খারাপ লাগার স্মৃতি মিশে আছে, সে প্রাঙ্গণ ছেড়ে এত দিন থাকতে হবে, কিংবা থাকলেও যে বারবার এই ক্যাম্পাসের কথা এত বেশি মনে পড়বে, বোধ হয় কেউ ভাবেনি।
সব সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপগুলোতে ক্যাম্পাসের ছবি খুঁজে ফিরি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ কিলোমিটার দূরে আছি। তারপরও প্রতিদিনই জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে আমার চেনা চত্বর? কেমন আছে রাতের কার্জন হল কিংবা শেষ রাতের ডিএমসির সামনের খাবারের দোকানগুলো? কেমন আছে রাতজাগা ভীষণ আলোকিত বিজনেস ফ্যাকাল্টি কিংবা মুহসীন হলের ছোট্ট বাগানটি? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো যেন ক্যাম্পাসের ছবিগুলোর মধ্যেই খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। কেউ কোনো কাজে ক্যাম্পাসের দিকে গেলেই বলি ছবি তুলে পাঠাতে। দূরে থেকেও মনে হয় কাছাকাছি আছি, ক্যাম্পাসেই আছি।
জানি না কবে সবার ফেরা হবে। অনেকেই হয়তো ফিরবে না, কত কিছু বদলে যাবে। কিন্তু তারপরও এই যে একটা অদৃশ্য সুতায় বাঁধা পড়ে আছি, এ এক অদ্ভুত মায়া। তাই এত দূর থেকেও ক্যাম্পাসের ছবিগুলো দেখলেই মনের অজান্তে বলে উঠি, ভালো থেকো টিএসসি, ভালো থেকো হাকিম চত্বর, ভালো থেকো কার্জন হল আর ভালো থেকো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শুধু দিন গুনছি
জাকিয়া হোসেন, ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা
চারদিকে আতঙ্ক, বিষণ্নতা, হাহাকার দেখি। প্রতিটা মুহূর্ত এক অনিশ্চয়তায় কাটছে। প্রতিটি ভোরই সৃষ্টিকর্তার কৃপা। তবু আশা হারাইনি। একদিন আবার একটা সোনালি ভোর আসবে, সেই ভোরে আমরা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখব। আবার ফিরব প্রিয় আঙিনায়, প্রিয় ক্যাম্পাসে। তত দিনে ক্যাম্পাসের গাছগুলোও নিশ্চয়ই সবুজে সবুজে ভরে উঠে আমাদের স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় থাকবে। কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো তার লাল রঙে রাঙিয়ে দেবে চারপাশ। আমাদের আড্ডায়, কোলাহলে ক্যাম্পাস ফিরে পাবে তার প্রাণশক্তি।
জানি প্রিয় ইডেন কলেজ আজ আমার মতোই ভালো নেই। আমাদের শূন্যতা নিশ্চয়ই সেও তীব্রভাবে অনুভব করছে। বান্ধবীদের সঙ্গে শেষ আড্ডাটা এখনো মনে পড়ে। সেদিন অনেকের সঙ্গে দেখা না হওয়ার কষ্টের পাশাপাশি অপ্রত্যাশিত ছুটি পেয়ে কিছুটা আনন্দও হয়েছিল। নিজের জন্য সময় পাচ্ছি, অনেক পরিকল্পনাও করতে শুরু করেছিলাম। করোনাকালীন এই বন্দিজীবনে একটু সুন্দর সময় কাটানোর জন্য প্রিয় বই পড়ি, সিনেমা দেখি, ছবি আঁকি। বাংলা সাহিত্য আমার আগ্রহের জায়গা। তাই এই বিরতিতে বাংলা সাহিত্যের বিপুল ভান্ডারের লেখক ও তাঁদের লেখনীর সঙ্গে একটা যোগসূত্র করার চেষ্টা করছি। তবু কোথাও কেন যেন উচ্ছ্বাস নেই, প্রাণ নেই। শুধু মনে হয়, মনে মনে আসলে আমরা সবাই শুধু দিন গুনছি। আমরা আমাদের সেই ব্যস্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। যেখানে একটানা বোরিং ক্লাস, প্র্যাকটিক্যাল, অ্যাসাইনমেন্টের চাপে ক্লান্ত হব। কিন্তু ক্যানটিনের ফুচকা, ভেলপুরি বা পুকুরপাড়ের চায়ের আড্ডায় আমাদের ক্লান্তি দূর হবে। আমরা ছুটে বেড়াব ক্যাম্পাসের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। পুরোনো দিন ফিরে পাব কি না জানি না, নতুন দিনের স্বপ্ন তো দেখতেই পারি।
করোনাকালের ভালোবাসা
দেবাশীষ রনি, গণিত বিভাগ, সরকারি এমসি কলেজ, সিলেট
স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে আছি প্রায় ১০০ দিন পেরিয়ে গেল। আমি ছবি তুলতে ভালোবাসি। শখের বশে ছবি তুলে আর সেগুলো ফেসবুকে আপলোড করে সময়টা কাটছিল। এ ছাড়া বই পড়া, নাটক-সিনেমা দেখা। হঠাৎ ভাবলাম, নতুন স্বাভাবিকতায় আমাদের প্রকৃতির জন্য ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ কিছু করা যায় কি না। শুরু করলাম বৃক্ষরোপণ।
অনেক দিন ধরেই আমি প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত। বছরজুড়েই ভালো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে আমাদের সংগঠন। বন্ধুসভার ভালো কাজের একটি হলো, ‘একজন বন্ধু দুটি গাছ’ কর্মসূচি। প্রতিবছর জুন মাসে প্রথম আলো বন্ধুসভার প্রত্যেক বন্ধু অন্তত দুটি গাছ লাগিয়ে এই কর্মসূচি পালন করেন। গত তিন বছরের জুনে কাজটি খুব সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। এ বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মসূচিটি শুরু হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। ভেবে দেখলাম, গত তিন বছরে যে চর্চাটা গড়ে উঠেছে, সেটা চালিয়ে নেওয়া উচিত।
১১ জুন এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা করি বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি শাহ সিকান্দার ও আরেক সদস্য মিহরাব আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে। আলোচনা করে ঠিক করলাম, নিজেদের উদ্যোগেই আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী গাছ রোপণ করব। ১৬ জুন শহরতলির টুকেরবাজারে শাহ খুররম ডিগ্রি কলেজে ২টি কড়ইগাছের চারা রোপণ করে আমাদের এই উদ্যোগের মূল কাজ শুরু হয়। ২০ জুন হাজির হই আমার নিজের ক্যাম্পাসে, যেখানে বসে আমরা বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা করেছিলাম। সঙ্গে নিয়ে যাই ১০টি রেইনট্রি, কাঠবাদাম, মেহগনি, টেকরই ফল ও চাপালিশগাছের চারা। দুজনে মিলে সেগুলো রোপণ করি। পরবর্তী সময়ে কোথায় গাছ লাগাব, সেটাও ঠিক করে নিই।
ধীরে ধীরে আমরা সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম এলাকা, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, টুকেরবাজার, বাদাঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতের শতাধিক গাছ লাগাই। শুধু গাছ লাগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না আমাদের এই ভালোবাসার কাজ। জামের বিচি, কাঁঠালের বিচি, লিচুর বিচি, আমের আঁটিসহ বিভিন্ন জাতের পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফলের বীজও রোপণ করেছি। যতবার কাজটি করতে গিয়েছি, ততবারই এক অন্য রকম ভালোলাগা, ভালোবাসার অনুভূতি কাজ করেছে।
আমাদের এই গাছ লাগানোর কাজ এখনো চলমান। গাছ লাগাতে গিয়ে খুব একটা ছবি তোলা হয় না। ছবি তুলে দেওয়ার মতো তখন সঙ্গে কেউ থাকেও না। একদিন বৃক্ষরোপণ শেষে ফেরার সময় এক লোক বলছিলেন, ১০-১৫ বছর পর যখন গাছগুলো বড় হবে, তখন তৃপ্তি নিয়ে বলতে পারবেন, এগুলো আপনার লাগানো। ভাবলাম, সত্যিই তো! রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে লাগানো এসব গাছ তখন নিশ্চয়ই আমার খুব আপন মনে হবে।
বিশ্বজুড়ে এই দুর্যোগের সময় ঘরে বন্দী থেকে আমরা উপলব্ধি করেছি, বাইরের পৃথিবীটা কত সুন্দর, আর আমরা এর ওপর কত অবিচারই না করেছি। বন, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র, মানুষের অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়নি। করোনাকাল আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, পৃথিবীটা আমার একার নয়। পশুপাখি, গাছপালা, নদী, সাগর, এই পৃথিবী সবার। সবাইকে ভালোবাসতে হবে। তাই আমি আমার এই উদ্যোগের নাম দিয়েছি করোনাকালের ভালোবাসা।
সূত্র: prothomalo.com