কৃষিবিদ ড. এম. মনির উদ্দিন
বীরের জাতি বাঙ্গালী। রক্ত দিয়ে মুখের ভাষাকে জয় করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এনেছে স্বাধীনতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই ভুখন্ডে অনেকবার দুভিক্ষ হানা দিয়েছে। ১৯৭০ এর ঝুর্নিঝড়ে ১০ লক্ষ মানুষ হারিয়েছে। ১৯৯১ এর ২৯ এপ্রিলে ঘুর্নিঝড়ে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ প্রান হারায় এবং আর্থিক ক্ষতি হয় তৎসময়ের ১.৭ বিলিয়ন ডলার। ২০০৭ এবং ২০০৯ সালে আঘাত হানে যথাক্রমে সিডর ও আইলা। এভাবেই আমরা বিভিন্ন দুর্যোগকে মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাচ্ছি।
চীনের উহান থেকে করোনা মহামারী আজকে সারা পৃথিবীতে আঘাত হেনেছে। বাংলাদেশেও গত ৮ই মার্চ থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে করোনার রোগী বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের উর্ধমুখী অর্থনীতিকে ইতিমধ্যে বাধাগ্রস্থ করেছে এই মহামারী। করোনার কারনে বিশ্বের ৩৬টি দেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। দেশের প্রবাসী আয়, গার্মেন্টস পোশাক রপ্তানীসহ অন্যান্য খাতের আয় ব্যাপকভাবে কমে গেছে এবং অদুর ভবিষ্যতে এ অবস্থা থেকে ভাল কিছু আশা করা দুস্কর। দেশের এই পরিস্তিতিতে কৃষিই হতে পারে অর্থনীতিকে সচল রাখার একমাত্র হাতিয়ার। তাই, এই মুহুর্ত থেকে আগামী এক বৎসরের জন্য কৃষির চলমান অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য নিতে হবে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা। সামনে কৃষির বিভিন্ন সাব-সেক্টরের গুরুত্বপুর্ন কিছু করনীয় রয়েছে যা সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের জন্য এখোনি নজর দেয়া আবশ্যকঃ
১। ধানের উৎপাদন আরো বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে আগামী আমন মৌসুমে যাতে বীজের পর্যাপ্ততা থাকে তা এখোনি নিরুপন করা দরকার। যে সমস্ত জমি থেকে বন্যার পানি দেরীতে নামে সেই সমস্ত জমিতে নাবী জাতের আধুনিক ও স্থানীয় জাতের আমন চাষের পরিকল্পনা করে প্রয়োজনীয় বীজ সহজলভ্য করে রাখা জরুরী।
২। আগামী বোরো মৌসুমের জমির পরিমান বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন বীজ সংরক্ষনের ব্যবস্থা করার জন্য উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক। বিএডিসি এ ব্যাপারে পরিকল্পনা নিয়ে বীজের চাহিদা পুরনের ব্যবস্থা করতে পারে। সেইসাথে হাওড় অঞ্চলে আগামী বোরো মৌসুমে ব্রি-ধান২৯ চাষের পরিবর্তে ব্রি’র আগাম জাতগুলো চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা দরকার। এতে, হাওড়ে বোরো ধান আগাম বন্যার ঝুকির মধ্যে থাকবে না।
৩। আগামী শীত মৌসুম পর্যন্ত প্রয়োজনীয় শাকসব্জির বীজ বাজারে যাতে স্বাভাবিক সরবরাহ অব্যাহত থাকে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক।
৪। আগামী রবি মৌসুমে বিভিন্ন ফসলের চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করা। রবি মৌসুমে ভুট্টা চাষের আওতায় যাতে জমির পরিমান বাড়ানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনা হওয়া উচিত।
৫। আগামী আমন মৌসুম থেকে শুরু করে রবি মৌসুম পর্যন্ত বিভিন্ন ফসল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় রাসয়নিক সার ও বালাইনাশক বাজারে যাতে পর্যাপ্ত থাকে তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ধান চাষে সরাসরি ইউরিয়া সার ব্যবহার না করে গুটি ইউরিয়া আকারে ব্যবহার করা যায় কিনা সেটাও চিন্তা করা যেতে পারে। কারন, এতে ৩০ ভাগ ইউরিয়া সারের সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি গড়ে ২৫ ভাগ ধানের ফলন বৃদ্ধি পাবে।
৬। করোনা পরিস্থিতিতে পরিবহন ব্যবস্থা অনেকটাই বন্ধ থাকার কারনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় উৎপাদিত শাকসব্জি চাহিদা সম্পন্ন এলাকায় নেয়া যাচ্ছে না বলে কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট সরকারী অধিদফতর বিশেষ করে কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতর ও কৃষি বিপনন অধিদফতর যৌথভাবে কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপন্য সুষ্ঠ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে কৃষকের ন্যায্যমুল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে পারে।
৭। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে আম লিচুর মৌসুম শুরু হবে। কৃষকের উৎপাদিত আম ও লিচু ব্যবসায়ীরা যাতে দেশের সব জায়গায় পৌছাতে পারে তার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে এখোনি। এতে উৎপাদকেরা ন্যায্য দাম পাওয়ার পাশাপাশি ভোক্তারাও হাতের কাছে আম লিচু কেনার সুযোগ পাবে।
৮। দেশে প্রানীজ আমিষ সরবরাহে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান অনেক। এই সেক্টরের উৎপাদন ও সরবরাহ চলমান রাখতে পোল্ট্রি ফিড তৈরীর প্রয়োজনীয় কাচামাল, ঔষধপত্র, ভ্যাকসিন ইত্যাদির সরবরাহ নিশ্চিত করা দরকার।
৯। গবাদিপশুর দানাদার জাতীয় খাদ্য বিশেষ করে গরু মোটাতাজাকরনের জন্য খামারীরা যাতে দানাদার জাতীয় খাদ্য বাজারে পায় বা সহজলভ্য হয় সেজন্য বিশেষ নজর রাখা দরকার। কারন দেশে এই সময়ে কমপক্ষে ১ কোটি ৩০ লক্ষ গরু মহিষ মোটাতাজাকরনের জন্য কৃষক/খামারীর বাড়ীতে বা খামারে রয়েছে। আগামীদিনে আমাদের প্রোটিনজাত খাদ্য সরবরাহের জন্য এটি একটি গুরুত্বপুর্ন সেক্টর।
১০। গবাদিপশু, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রানীর জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন সহজলভ্য করা ও মাঠপর্যায়ে ভ্যাকসিন সেবা পৌছে দেয়া একান্ত প্রয়োজন।
১১। ডেইরী খামারীরা তাদের উৎপাদিত দুধ নিয়ে যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছে তা থেকে তাদের রক্ষা করতে খামারীদের দুধ সংগ্রহ করে বাজারে সরবরাহের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দুধ প্রক্রিয়াজাতের পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।
১২। এই সংকট পরিস্থিতির মধ্যেও গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজননের সেবা মাঠ পর্যায়ে সহজলভ্য করা প্রয়োজন।
১৩। পুকুরে মাছ চাষের মৌসুম চলছে। মৎস্য চাষীরা যাতে তাদের পুকুরে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পোনা পায় বা পরিবহন ব্যবস্থায় দুর থেকে আনতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা দরকার। হালদা নদীর সংগৃহীত ডিম থেকে উৎপাদিত রেনু যাতে স্বাভাবিকভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহজে পৌছে দেয়া যায় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা আবশ্যক। সরকারী ও বেসরকারী হ্যাচারীগুলোর মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং সারাদেশের বদ্ধ জলাশয়সহ সামনের বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন মুক্ত জলাশয়ে ব্যাপকভাবে পোনা অবমুক্তকরনের কর্মসুচী গ্রহন করা প্রয়োজন।
১৪। দেশে চলমান বিভিন্ন উৎস থেকে স্বাভাবিকভাবে মৎস্য আহরন কার্যক্রমকে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করা এবং সংগৃহীত মাছ দেশের বিভিন্ন বাজারে বা বিক্রয়কেন্দ্রে সরবরাহ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা।
১৫। আগামী ৩০ শে জুন পর্যন্ত জাটকা ধরা নিষিদ্ধ এবং এরপর ব্যাপকভাবে ইলিশ আহরন শুরু হবে। এ সময় ইলিশ যাতে সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সর্বত্র পৌছানো যায় তার যথাযথ পরিকল্পনা ও যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা দরকার।
দেশে করোনার এই ক্রান্তিকালে সরকারী স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। দেশে চলমান পরিস্থিতিতে সাধারন ছুটি সেইসাথে অনেক জেলা উপজেলায় লকডাউন চলছে। কিন্তু কৃষির সব কাজ সফল করতে দরকার সময়মত পদক্ষেপ গ্রহন ও বাস্তবায়ন। অসময়ে কৃষি করলে কোন লাভ হবে না। করোনার এই সংকটকালে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র হাতিয়ার হলো কৃষি। তাই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও অধিদফতরগুলোকে যে কোন উপায়েই হোক না কেন, মাঠ পর্যায়ে থেকে এ সমস্ত করনীয় কাজগুলোকে গুছিয়ে করতে হবে এখোনি। কৃষক বা খামারীরা সব করবে এই রকম ভাবনাটা মোটেই ঠিক হবে না। সামনে আমাদের কৃষিতে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে হবে। তাহলে, বিশ্ব অর্থনীতির এই মহা-মন্দার মধ্যেও আমরা অনেক দেশের তুলনায় ভাল থাকতে পারবো।