নিজস্ব প্রতিবেদক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগে এবং দেশত্যাগের পরে এলাকা ছাড়তে শুরু করেন টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের এমপি, প্রতিমন্ত্রী ও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
বর্তমানে তাদের সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারছেন না।
অনেকেই আত্মরক্ষার্থে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তারা এখন তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করা তো দূরের কথা, অনেকে নেতাকর্মীদের ফোনও ধরছে না, কারো কারো মোবাইলও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
আরো পড়ুন – জামায়াত-শিবির কোথাও সন্ত্রাস করে থাকলে প্রমান দিন; আমরাই বিচার করব
চলমান এই পরিস্থিতিতে জেলায় প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ও শামছুন্নাহার চাপা, সাবেক সংসদ সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির, সাবেক সংসদ সদস্য খান আহমেদ শুভ, সাবেক সংসদ সদস্য অনুপম শাজাহান জয়, জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত আমানুর রহমান খান রানার বাড়িঘরে ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. ছানোয়ার হোসেনের বাড়ি ভাঙচুর না করা হলেও আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি-প্রতিমন্ত্রী সহ বিভিন্ন পৌরসভার মেয়র ও জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের সাথে তিনিও বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের কমান্ডার ইন চিফ ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর বহিষ্কৃত সদস্য এবং সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন করায় তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
ঘটনা –
জানা গেছে, সারাদেশের ন্যায় টাঙ্গাইলেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে ছাত্র-জনতা।
গত ৪ আগস্ট টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন স্থানে ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও গুলিবর্ষণের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে টাঙ্গাইল।
এতে গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশত আহত হয়।
এরপরই ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলামের (ভিপি জোয়াহের) গাড়িতে আগুন ও বাড়িতে ভাঙচুর করে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হামলার সময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে অবস্থান করছিলেন।
টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
এরপর আন্দোলনকারীরা টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের টাঙ্গাইল শহরের পূর্ব আদালত পাড়ার বাসায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
পরে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে টাঙ্গাইল শহর বাইপাস আশেকপুরের দরুণ এলাকায় সাবেক এমপি তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের মালিকানাধীন দি টাঙ্গাইল ফিলিং স্টেশন ও “ধ্রুব ইন” রেস্তোরাতেও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে পৌর ভবনে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা নিয়মিত অবস্থান করতেন।
সেখান সভা করেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এজন্য আন্দোলনকারীদের আক্রোশ ছিলো পৌর ভবনের ওপর।
ওইদিন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এসএম সিরাজুল ইসলাম আলমগীরের বাসা ও পৌরসভায় ব্যাপক ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়।
এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর ও আসবাবপত্রে আগুন দেওয়া হয় এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন তোফার বাসায় ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।
৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের জরুরী সভা –
এসব হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর গত ৪ আগস্ট রাতে সার্কিট হাউসে জেলা আওয়ামী লীগের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এতে ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক, সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম, যুগ্ম-সম্পাদক ও সাবেক এমপি তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি খান আহম্মেদ শুভ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক স্বতন্ত্র এমপি মো. ছানোয়ার হোসেন, আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ, পৌর মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীর, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আশরাফুজ্জামান স্মৃতি, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন তোফা, সাংগঠনিক সম্পাদক জামিনুল রহমান মিরন ও সাইফুজ্জামান সোহেলসহ জেলার নেতারা।
আগের রাতে আলোচনা হলেও পরেরদিন আর তাদের মাঠে দেখা যায়নি।
ওইদিন দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগের পর এমপি, সিনিয়র ও প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা এলাকা ছাড়া হয়ে যান।
এরপর তারা কে কোথায়, কেউ তাদের সাকিন জানে না।
এর মধ্যে জেলার দ্ইুজন নেতা জানিয়েছেন যে, আমরা জরুরী বৈঠক করেছি ঠিকই, কিন্তু সবারই মনোবল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
নেতাকর্মীদের অবস্থান –
একটি সূত্র জানিয়েছে যে, শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর কালিহাতী উপজেলার ভূক্তা এলাকায় পালিয়ে থাকা তানভীর হাসান ছোট মনির সেনা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্থন করেছে।
কিন্তু ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
অপরদিকে জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা সোলায়মান হাসানকেও পালিয়ে যাওয়ার সময় বিমান বন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
আরো পড়ুন – টাঙ্গাইল-২ আসনের এমপির বাসা ভাঙচুর-অগ্নিকাণ্ড
আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পরে ছাত্রদের কাছে।
এসময় তিনি গণধোলাইয়ের স্বীকার হয়ে এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা যা বলেন –
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলেন, দলীয় মন্ত্রী-এমপি বা জেলার নেতারা কে কোথায় আছেন তা কেউ জানে না।
কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
শুধু জেলার নেতারাই নয়, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও হামলার ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
তবে এখনও তাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে যেতে না পেরে দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন।
সুবিধামতো সময়ে অনেকে হয়তো বিদেশে পারি জমাতে পারেন।
শহরের আদালত পাড়া, থানা পাড়া ও মির্জাপুরের বেশ কয়েকজন সক্রিয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী বলেন, কার সাথে রাজনীতি করলাম? কার জন্য এতদিন কাজ করলাম?
তারা আমাদের ফেলে শুধু পালিয়েই যায়নি, আমাদের খবরটাও নিচ্ছে না।