কুরবানির পশুর মাংস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করণীয়

কয়েকদিন পরেই পালিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পশু কুরবানি করা। এদিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে পশুর রক্ত ও উচ্ছিষ্টাংশ থেকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা রয়ে যায়। আর বর্জ্য থেকে বিভিন্ন রোগবালাই ছড়ানোর আশঙ্কা তো থাকেই। এজন্য পশু কুরবানির পর সার্বিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে আমাদের সবারই নজর দিতে হবে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি কুরবানির পশুর বর্জ্য যথাযথভাবে পরিষ্কার করা না হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবেই নানারকম মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তাই কুরবানির পশুর রক্ত, হাড়, নাড়ি-ভুঁড়ি, মল ইত্যাদি যথাযথভাবে পরিষ্কার করা দরকার এবং তা যেন পরিবেশকে অস্বাস্থ্যকর করে না তোলে, সেদিকেও সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত।

পাশাপাশি একটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, এবারের ঈদুল আজহার প্রেক্ষাপট কিন্তু অন্য বছরের তুলনায় একটু আলাদা। কারণ এবারের কুরবানির ঈদ এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে; যখন বাংলাদেশসহ বিশ্ব করোনাভাইরাস মহামারীর কবলে আক্রান্ত। তাই পশু কোরবানির সময় একজন থেকে আরেকজনে করোনাভাইরাস যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্যও অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কুরবানির পশুর মাংস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কিছু কিছু বিষয় আমাদের অবশ্যই পালন করা উচিত।

নির্দিষ্ট স্থান নির্বাচন: পশু কুরবানি দেওয়ার আগেই স্থান নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত বসতবাড়ি থেকে কুরবানির জায়গা একটু দূরে হলে ভালো হয়। নির্ধারিত পরিচ্ছন্ন জায়গায় কুরবানি দিলে মাংসে আবর্জনা ও জীবাণু মিশ্রণের সম্ভাবনা কম থাকে এবং মানসম্পন্ন মাংস পাওয়া যায়। যদি যথাযথ ব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে কুরবানির পশু নির্ধারিত স্থানে জবাই করা হয়, তাহলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ রোধ হবে; তেমনি অন্যদিকে জবাই পরবর্তী উচ্ছিষ্টাংশগুলো সম্পদে রূপান্তরিত করা সহজ হবে। কারণ পশুর ফেলে দেওয়া নাড়ি-ভুঁড়ি থেকে উৎকৃষ্টমানের মাছের খাদ্য বা পশু খাদ্য তৈরি করা সম্ভব, একইভাবে পশুর হাড় গুঁড়া করে পশু খাদ্য বা উৎকৃষ্ট মানের সারও তৈরি করা যায়। ওষুধ শিল্পেও কুরবানির পশুর হাড় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পশুবর্জ্যকে এভাবে ব্যবস্থাপনায় আনলে কুরবানি পরবর্তী নগর-গ্রাম দূষণমুক্ত থাকবে এবং জনস্বাস্থ্যও বিঘ্নিত হবে না। এছাড়া নির্ধারিত স্থানে কুরবানির ব্যবস্থা করলে সঠিকভাবে চামড়া ছাড়ানো সহজ হয় এবং সহজেই বিক্রি করে ভালো মূল্য পাওয়া যায়।

যত্রতত্র কুরবানির বর্জ্য না ফেলা: কুরবানির পশুর গোবর বা অন্যান্য উচ্ছিষ্টের একটি বড় অংশ যদি খোলা জায়গায় বা ড্রেনে ফেলা হয়, তাহলে আশপাশে প্রকট দুর্গন্ধ ছড়াবে এবং অনেক ড্রেন বন্ধ হয়ে রাস্তায় ড্রেনের ময়লা উপচে আশপাশের পরিবেশ দূষিত করবে। এ ধরনের পরিকল্পিত ব্যবস্থা তৈরিতে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন প্রতিবছরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাধারণ জনগণ হিসাবে আমাদের উচিত স্বাস্থ্যসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সবার যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এলাকাভিত্তিক অস্থায়ী নির্ধারিত জায়গা তৈরি করতে হবে, যেন কুরবানির পশু জবাইয়ের পরে উচ্ছিষ্ট রক্ত, হাড়, চামড়া, গোবর, নাড়ি-ভুঁড়ি আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করে তা যথাযথ সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব হয়। কুরবানির পর যতদ্রুত সম্ভব ময়লা-আবর্জনা ও পশুবর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য নির্ধারিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।

গর্ত তৈরি করে রাখুন: কুরবানির আগেই বাড়ির পাশে কোনো মাঠে কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায় একটি গর্ত তৈরি করে রাখুন। আর শহর হলে নির্দিষ্ট ডাস্টবিন নির্ধারণ করে রাখুন। শহরে যারা থাকেন, তারা বিচ্ছিন্ন স্থানে কুরবানি না দিয়ে বেশ কয়েকজন মিলে একস্থানে কুরবানি করা ভালো। এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজ করতে সুবিধা হয়। তবে কুরবানির জায়গাটি যেন খোলামেলা হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। জায়গাটি রাস্তার কাছাকাছি হলে বর্জ্যের গাড়ি পৌঁছাতে সহজ হবে। যেসব এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয় বা দেরি হয়, সেসব ক্ষেত্রে মুখ বন্ধ করা ব্যাগে বর্জ্য ভরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন।

উচ্ছিষ্ট এক জায়গায় রাখুন: মাংস কাটার সময় উচ্ছিষ্টগুলো যেখানে-সেখানে না ফেলে এক জায়গায় রাখুন। কাজ শেষে সেগুলো গর্তে পুঁতে ফেলুন বা নির্ধারিত ডাস্টবিনে ফেলুন। পশুর ভুঁড়ি পরিষ্কারের পর সেই আবর্জনাও খোলা অবস্থায় না রেখে গর্তে পুঁতে ফেলুন বা ডাস্টবিনে ফেলুন।

রক্তমাখা স্থান ধুয়ে ফেলুন: কুরবানির সব কার্যক্রম শেষে যেখানে পশু কুরবানি, চামড়া ছাড়ানো ও মাংস কাটাকাটি করা হবে; সেখানে রক্তমাখা স্থান ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলুন। জীবাণু যেন ছড়াতে না পারে সেজন্য নোংরা জায়গা পরিষ্কারের সময় স্যাভলন মেশানো পানি ব্যবহার করুন ও ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিন। ওই স্থান ভালো করে শুকিয়ে ফেলুন।

চামড়া ব্যবস্থাপনা: যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পশুর চামড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিন। এছাড়া বিভিন্ন মাদরাসা, মসজিদ বা এতিমখানায় দান করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

শরীরের নিরাপত্তা: বর্তমানের করোনা পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে আরও কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত। যারা কুরবানি, চামড়া ছাড়ানো ও মাংস কাটাকাটির সাথে জড়িত থাকবেন, তাদের অবশ্যই হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক এবং পায়ে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা রাবারের জুতা পরা আবশ্যক। কুরবানির কাজ শুরুর আগে ও শেষে দুই হাতসহ পুরো শরীরের অনাবৃত অংশ সাবান ও হালকা গরম পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। কোরবানির পশু, চামড়া ও খোলা মাংসের আশপাশে কোনো অবস্থাতেই হাঁচি-কাশি দেওয়া অনুচিত। কুরবানি, চামড়া ছাড়ানো ও মাংস কাটাকাটির জায়গায় ভিড় করা চলবে না। যারা কুরবানির কাজগুলো করবেন, সম্ভব হলে তাদের অবশ্যই অন্তত নিজেদের মাঝে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

পাত্র ধুয়ে নিন: মাংস রাখার পাত্র ব্যবহারের আগে ও পরে অবশ্যই সাবান-পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। রান্নার সময় কাঁচা মাংস নাড়াচাড়ার আগে ও পরে হাত ভালো করে সাবান ও হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। মাংস ভালোভাবে রান্না করতে হবে, যেন মাংসের প্রতিটি অংশ যেন ভালোভাবে সেদ্ধ হয়। কাঁচা মাংসের পাত্র, কাটিং বোর্ড, ছুরি, বঁটি প্রভৃতি হালকা গরম পানি ও সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে।

মাংস সংরক্ষণ: রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ছোট প্যাকেটে মুখ বন্ধ করে মাংস রাখুন। রেফ্রিজারেটর থেকে বের করে কাঁচা মাংস ধরার পরে ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।

এককথায় বলতে গেলে, কুরবানির পর আমাদের সচেতনতাই পারে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ স্বাস্থ্যকর হিসাবে বজায় রাখতে। পাশাপাশি আমরা যেন শুধুমাত্র পশু কুরবানির মাধ্যমেই ‘ত্যাগ’ শব্দটি সীমাবদ্ধ না রাখি। আমাদের ত্যাগ যেন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতীক হয়- সেদিকেও আমরা নজর রাখবো।

সূত্র: jagonews24.com/feature/