টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে আওয়ামী লীগ নেতা স্বামীর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রায় ২২ বছর ধরে একই কর্মস্থলে রয়েছেন শারমিন আরা নামের এক এলজিইডি’র অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক। শুধু তাই নয় তার বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য, অনিয়মিত অফিস, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও তার স্বামীকে ঠিকাদারী লাইসেন্স করে দিয়ে নিয়মিত কাজ পাইয়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। শারমিন আরা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেলদুয়ার উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে কর্মরত রয়েছেন।
জানা গেছে, শারমিন আরা ২০০৪ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেলদুয়ার উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে যোগদান করেন। চাকরির সুবাদে তার পরিচয় হয় শাহীন মিয়া নামের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সাথে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এর সুবাদে আওয়ামী লীগ নেতা শাহীন মিয়া শারমিন আরা’র কার্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতা শাহীন মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় শারমিন আরা’র। এরপর থেকেই স্বামী-স্ত্রী মিলে এলজিইডিতে শুরু করে রাম রাজত্ব। কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক শারমিন ঠিকাদারদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা না নিয়ে কোন প্রকার বিল ও চিঠি টাইপের কাজ করতেন না। আগে টাকা পরে কাজ এমন পদ্ধতি চালু করেন তিনি।
স্ত্রী এলজিইডি অফিসে চাকরি করার সুবাদে ঠিকাদার বনে যান স্বামী শাহীন মিয়া। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ভাগিয়ে নেন বিভিন্ন ঠিকাদারী কাজ। আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রভাবশালী ঠিকাদার হয়ে নামে-বেনামে একাধিক লাইসেন্স করেন তিনি। বাড়িতে বিল্ডিংসহ অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা। স্ত্রীর সঙ্গে পুরো অফিসকালীন সময় পাড় করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা শাহীন মিয়া। এমন অবস্থায় প্রকৌশলী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। স্বামী-স্ত্রীর কথা না শুনলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করে দেওয়াও ঘটনা ঘটেছে। শারমিন আরা’র বিরুদ্ধে অনিয়মিত অফিস করার অভিযোগও রয়েছে। বেলা ১১টার আগে তিনি অফিসে আসেন না। আবার দুপুর হলেই কর্মস্থল ত্যাগ করেন।
যা জানা যায় –
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে আরএমপি ও এলসিএস জিওবি মেইনটেনেন্স প্রকল্পের আওতায় মহিলাকর্মী ও সুপারভাইজার পদে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন শারমিন আরা। সেলিম মিয়া নামের এক সুপারভাইজার চলতি বছরের মার্চ মাসের শুরুতে বিদেশ যাওয়ার কারনে পদ শূন্য হয়। পরে শারমিন আরা ও শাহীনের ভাগ্নে মো. জিসান আহমেদকে অনিয়মের মাধ্যমে সুপারভাইজার পদে নিয়োগ দেয়। এই দীর্ঘ সময়ে একবার বদলি করা হলেও স্বামী শাহীন মিয়া আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় তিনি অন্যত্র যোগদান করেননি। সেই বদলির আদেশ বাতিল করে দেলদুয়ারেই স্বপদে থেকে যান তিনি। একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন থাকায় ঠিকাদার ও এলজিইডি কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। এমতাবস্থায় অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক শারমিন আরাকে অন্যত্র বদলি ও শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্ট ভ‚ক্তভোগীরা দাবি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহীন মিয়ার বাড়ি উপজেলা পরিষদের পাশেই। তিনি আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শীর্ষ নেতার অনুসারী হয়ে দাপটে চলতেন। সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটুর অনুসারী ছিলেন।
ভূক্তভোগীদের কথা –
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধকি ঠিকাদার জানান, ‘ই-জিপি টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ প্রাপ্ত হয়ে ধাপে ধাপে কাজ শেষ করা হয়। সেই কাজের চলতি বিল তৈরি করতে বললে শারমিন আরা টাকা দাবি করেন। পরে চার ধাপে দুই হাজার করে টাকা দিয়ে বিল উত্তোলনের কাগজ প্রস্তুত করতে হয়। টাকা না দিলে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ঠিকাদারদের সাথে খারাপ আচরণ করেন। তার স্বামীও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসে বসে থাকেন এবং ঠিকাদারীর কাজ ভাগিয়ে নেন। উপজেলার নিকটবর্তী বাড়ি ও আওয়ামী লীগের প্রভাব থাকায় কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। প্রায় ২২ বছর ধরে এভাবেই ক্ষমতা খাটিয়ে অফিসে কাজ করছে শারমিন। তাকে দ্রুত এখান থেকে বদলি ও শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।’
উপজেলা এলজিইডি কার্যালয়ে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে কর্মরত শারমিন। আবার তার শশুরবাড়িও উপজেলা পরিষদের পাশেই, স্বামীও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও ঠিকাদার। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে সমস্যা, কারণ আমরা দূরের মানুষ। চাকরি করতে এসেছি, কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না।’
ভূক্তভোগী মেসার্স এস হোসাইন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্তধার শাহাদত হোসাইন সাধু বলেন, ‘বিল টাইপ করার জন্য শারমিন আরা প্রত্যেক ঠিকাদারের কাছ থেকে দুই হাজার করে টাকা নেন। টাকা না দিলে কাজ করে না। সকালে তাকে অফিসে পাওয়া যায় না। দুপুর ১২টায় অফিসে এসে আবার ৩টায় চলে বাড়িতে চলে যায়। বিল টাইপের জন্য টাকা না দেওয়ায় আমার সাথে চিৎকার-চেঁচামেচি ও খারাপ আচরণ করেন। তার স্বামী শাহিন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। এর প্রভাব খাটিয়ে অফিসের কাউকেউ তোয়াক্কা করেন না। তার বিষয়ে আপনারা লিখলে (সাংবাদিক) অফিস স্টাফ ও সব ঠিকাদাররা খুশি হবে। একই কর্মস্থলে এতদিন তিনি কিভাবে থাকেন। তার অনিয়ম ও আচরণে সবাই ক্ষুব্দ। তাকে দেলদুয়ার থেকে দ্রæত বদলি করা প্রয়োজন। তাকে যেন আর এই কর্মস্থলে ফিরতে দেওয়া না হয়।’
সাবেক কর্মকর্তার মন্তব্য –
দেলদুয়ার উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী র্বর্তমানে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মো. ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি সেখানে দুই বছর কর্মরত ছিলাম। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকের দায়িত্বে থাকা শারমিন আরা’র দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ঠিকাদার থেকে শুরু করে অফিসের কেউই কথা বলার সাহস পেতেন না। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে মিথ্যা শ্লীলতাহানীর অভিযোগ আনা হতো। শারমিন প্রত্যেক ঠিকাদারের কাছ থেকে বিল টাইপের জন্য ২ থেকে ৩ হাজার করে টাকা নেয়। টাঙ্গাইল থানা পাড়া এলাকার সাধু নামের এক ঠিকাদার ঘুষের টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তার অন্ডকোষ চেপে ধরেন শারমিন আরা। তিনি বেলা ১১টায় অফিসে এসে আবার দুপুর ২টায় চলে যায়। বিষয়টি নিয়ে ওই সময়ের উপজেলা প্রকৌশলী খ.ম ফরহাদ হোসাইনের সাথেও খারাপ আচরণ করেন শারমিন ও তার স্বামী শাহিন।
তিনি আরো বলেন, শারমিনের স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় ও তার বড় বোন এলজিইডি প্রধান কার্যালয়ের তৎকালীন অফিস সহকারী পদে থাকায় ক্ষমতার দাপট দেখাতেন। তারা দাপট দেখিয়ে ওই সময় উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে থাকা রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়াকে রাঙ্গামাটি বদলি করেন। শারমিনের কার্যক্রমে অফিসের স্টাফ ও ঠিকাদাররা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। একই কর্মস্থলে ২১ বছরের ওপরে তিনি চাকরি করেন কিভাবে। এই কর্মস্থল থেকে তাকে জরুরিভাবে বদলি ও শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ।’
এ বিষয়ে দেলদুয়ার উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী র্বর্তমানে মধুপুর উপজেলা প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘আমি সেখানে ৭ বছর চাকরি করেছি। তার আচরণ কোনো সরকারি চাকরিজীবির মতো ছিল না। তার স্বামী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় তিনি দাপটে চলতেন। তার আচরণ ও ঘুষ বাণিজ্যে অফিস স্টাফ ও ঠিকাদাররা অতিষ্ঠ। তাকে এই কর্মস্থল থেকে বদলি করা জরুরি।’
দেলদুয়ার উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের সাবেক উপজেলা প্রকৌশলী মো. আব্দুল বাছেদ বলেন, ‘সরকারি নিয়ম হলো এক জায়গায় তিন বছরের বেশি থাকার কথা না। এখানে ২০ থেকে ২২ বছর থাকে, এটা কাম্য না। ওনি তো কম্পিউটার অপারেটর, ঠিকাদারের বিল টাইপের সাথে তার সম্পর্ক থাকে। তার স্বামীর বাড়িও এখানে। লোকাল প্রভাব থাকতে পারে।’
অভিযুক্ত শারমিনের বক্তব্য –
সম্প্রতি এলজিইডি কার্যালয়ে সরেজমিনে গেলে শারমিন আরার স্বামী শাহিন মিয়াকেও আড্ডা দিতে দেখা যায়। এসময় শাহীন মিয়া বলেন, ‘আমি কোন দল করি না। ঠিকাদারী করি টুকটাক তাও এলজিইডির কাজ কম করি। স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তাকে দিয়ে যাই। অফিসের সবার সাথে আড্ডা দিয়ে আবার চলে যাই।’
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা এলজিইডি কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক শারমিন আরা বলেন, ‘দেরিতে অফিসে আসি এটা সবাই জানে। আমার সুচিবাই (মানসিক সমস্যা) থাকার কারণে অফিসের টয়লেট ব্যবহার করি না। তাই বাসার কাজ ও টয়লেট সমস্যার কারণে দেরিতে আসতে হয়। তবে অফিসে যতক্ষণ কাজ আছে ততক্ষণ কাজ শেষ করে বাসায় যাই। এতে যদি রাত ১০টাও বাজে তবুও কাজ শেষ করি। ঠিকাদারদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেয়া হয় না। এটা মিথ্যা তথ্য। তবে কেউ যদি খুশি হয়ে দেয় সেটা ছাড়া কোন টাকা নেয়া হয় না। অসুস্থতার কারণে আমার স্বামী সকালে দিয়ে যায় আবার অফিস সময় শেষে নিয়ে যায়।’
বর্তমান কর্মকর্তাদের বক্তব্য –
উপজেলা প্রকৌশলী আহমেদ তানজীর উল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘শারমিনকে বদলি করা হয়েছিল কিন্তু নারী দেখে মানবিক কারণে পরে এই স্টেশনেই রাখা হয়েছে। তবে মানবিক কারণ তিনি দেখাতে পারেননি। লিখিত অভিযোগ না পেলে একজনকে তো বদলির বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখতে পারি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার কক্ষে আমরা কম যাই। পিয়ন দিয়ে কাগজপত্র তার কাছে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে কোন লিখিত অভিযোগ দেয়নি কেউ। এছাড়া ঠিকাদাররা যদি কোন লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জেলা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।