কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে ৫ হাজার অনুপ্রবেশকারীর তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর অনেকেই আওয়ামী লীগের জেলা-মহানগর, উপজেলা-থানা, ইউনিয়ন কমিটির পদ-পদবিতে আছেন। আবার কেউ দলের কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় ‘মোটাতাজা’ হচ্ছেন। এ তালিকা দেখে খোদ দলের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্যের চোখ ছানাবড়া। শুরু হয়েছে দলের ভিতরে-বাইরে তোলপাড়। খুব দ্রুতই শুরু হবে এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন। গতকাল সম্পাদকমন্ডলীর সভায় এ তালিকা ধরে ব্যবস্থা নিতে জেলায় জেলায় চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
সূত্র জানান, বিভিন্ন দল থেকে হাইব্রিডরা আওয়ামী লীগে ভিড়তে শুরু করে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরপরই। প্রথম দিকে এ হার খুব কম ছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অনুপ্রবেশ আশঙ্কাজনকহারে বাড়তে থাকে। ২০১৩, ’১৪ ও ’১৫ সালের আগুন সন্ত্রাস, পেট্রোল বোমায় মানুষ হত্যাসহ আন্দোলনের নামে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে অনেকেই জেলা-উপজেলা, ইউনিয়নের পদ-পদবি পেয়ে যান।
২০১৬ এমনকি ২০১৭ সালেও বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী কেন্দ্রীয় নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। নানা অঘটনের সঙ্গে জড়িত থাকার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধও বাড়িয়ে ফায়দা নিতে থাকেন তারা। বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের পেটানো, হামলা-মামলা করে ঘরছাড়া করার ঘটনাও ঘটে। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রবেশকারী সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপি-জামায়াত থেকে কাউকে দলে নিতে নিষেধও করেন প্রধানমন্ত্রী। এর পরও থেমে থাকেনি বিএনপি-জামায়াতের একশ্রেণির নেতা-কর্মীর আওয়ামী লীগে যোগদান। সে কারণে এবার দলীয় প্রধান নিজ উদ্যোগেই তালিকা তৈরি করেছেন অনুপ্রবেশকারীদের। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের।
সূত্রমতে, গত ৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীর তালিকা করার নির্দেশ দেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দেন নব্য লীগারদের খুঁজে বের করতে। এর এক মাস পর আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনিসহ কয়েকজন নারী নেত্রীকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর মূলত বিএনপি ও জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী, অপরাধী এবং সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন তিনি। কয়েক মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে ৫ হাজার অনুপ্রবেশকারীর তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। নব্য লীগার বা অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৫ হাজার জনের তালিকা গত বুধবার দলের দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের হাতে দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ তালিকা ফটোকপি করে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে তুলে দিতে নির্দেশ দেন দলীয় সভানেত্রী। গতকাল আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর বৈঠকে প্রথমে তালিকাটি উপস্থাপন করেন দলের দফতর সম্পাদক। সন্ধ্যায় ফটোকপি করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েক নেতার হাতে তালিকা তুলে দেন তিনি। অনুপ্রবেশকারীদের যোগদানকারী, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা, বর্তমান ও সাবেক বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, স্থানীয় শীর্ষ নেতার নাম রয়েছে। এ তালিকা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়েছে খোদ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।
সম্পাদকমন্ডলীর বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীর একটি তালিকা নেত্রী (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে তৈরি করিয়েছেন। সে তালিকা তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলায় জেলায় তালিকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখন থেকেই যদি কেউ পদ-পদবিতে থাকেন তাদের বের করে দেওয়া হবে। আগামীতে তারা কোনো সম্মেলনে অংশ নিতে পারবেন না।’
সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের একটি তালিকা দিয়েছেন। সে তালিকা অনুযায়ী আমরা কাজ শুরু করব। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তারা দলীয় পদ-পদবিতে থাকতে পারবেন না। আগামীতেও কেউ আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের পদে আসতে পারবেন না।’
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও দলীয় সভানেত্রীর নিজস্ব টিমের মাধ্যমে দলে অনুপ্রবেশকারীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সে তালিকা আমাদের হাতে। এখন আর কথা নয়, অ্যাকশন শুরু করব।’ কতজনের তালিকা- জানতে চাইলে নানক বলেন, ‘৫ হাজার জনের মতো হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্পাদকমন্ডলীর একাধিক সদস্য জানান, ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর অনেক এমপি, কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা নিজস্ব বলয় ভারী করতে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির নেতাদের দলে টেনেছেন। আবার অনেকেই নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য বহাল তবিয়তে রাখতে আদর্শ বদল করেছেন। অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে কারা আছেন তাদের নামও তালিকায় দেওয়া হয়েছে।
রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে অলরেডি ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছি। কয়েকদিন আগে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় একটি ওয়ার্ডের সভাপতির ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আসছে ২০-২১ ডিসেম্বর সম্মেলনের আগেই অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তাদের দলের পদ-পদবিতে রাখা হবে না। একই সঙ্গে তারা আগামীতে কেন্দ্রীয় সম্মেলনসহ সহযোগী সংগঠন ও স্থানীয় জেলা-উপজেলা কোনো সম্মেলনেই অংশ নিতে পারবেন না।’