ডেস্ক নিউজ : রিমঝিম বৃষ্টি এমনিতে সবার রোমান্টিক লাগলেও, সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হল বজ্রপাত।
ইতিমধ্যেই সারা দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা রোজই খবরের শিরোনামে আসছে।
আমাদের রাজ্যে এর ব্যতিক্রম নয়।
তাই আমাদের এই বজ্রবিদ্যুৎ সম্পর্কে এবং এর থেকে কী কী বিপদ হতে পারে তা সম্পর্কে আমাদের একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।
আর তার সাথে সাথে আমরাও জেনে নেব কীভাবে আমরা আমাদের এই বজ্রপাতের সময় নিজেদের সুরক্ষিত রাখবো।
বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহার করা কি নিরাপদ?
আমাদের সবার মধ্যে একটা ধারণা আছে যে এইসব জিনিস ব্যবহার না করাই উচিত বজ্রপাতের সময়।
তবে আজ আমরা এইসব ধারণার যুক্তিসহ ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করবো এই প্রতিবেদনে।
বজ্রপাত আসলে কি? প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই হয় বৃষ্টিপাত।
আমরা যারা ভূগোল পড়েছি ছোট বেলায় তারা জানি কীভাবে মেঘ তৈরি হয়।
সেখানে জেনেছি সূর্যের তাপে পৃথিবী পৃষ্ঠের বিভিন্ন জায়গায় যে জল থাকে তা বাষ্পীভূত হয়ে, এবং বায়ু গরম হতে থাকে।
গরম বাতাসের ঘনত্ব কম হয়ে যাওয়ার জন্য তা হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং এর সঙ্গে বাতাসের সঙ্গে থাকা জলীয় বাষ্প শীতল হয়ে ঘনীভূত হয় এবং ধুলোবালির সংস্পর্শে এসে মেঘের সৃষ্টি করে।
গরম বাতাস যত বেশি উপরের দিকে উঠতে থাকে, মেঘের আকার বড় থেকে আরও বড় হতে থাকে।
মেঘের একদম চূড়ায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নেমে যায় এবং সেখানে জল জমে বরফে পরিণত হয়।
এইরকম হাজার হাজার মেঘের কনা যখন ঘুরতে থাকে তখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়।
যার ফলে দুটি বিপরীত আধানের সৃষ্টি হয়। এইভাবে হালকা ধনাত্মক আধান থাকে মেঘের উপরের অংশ এবং ভারী ঋণাত্মক আধান থাকে মেঘের নীচের দিকে।
এইভাবে যখন এই ধনাত্মক আধানের মেঘের অংশও ঋণাত্মক আধানযুক্ত মেঘের অংশ যখন পরস্পরের সামনে চলে আসে তখন ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয় যাকে আমরা বলি বজ্রপাত।
সাধারণত বেশিরভাগ বজ্রপাত মেঘের ভিতরেই হয়। তবে কখনো কখনো এটা দুটি মেঘের মধ্যে বা ভুমিতেও হতে পারে।
আর যখন এটা ভূমি বা ভূমি সংলগ্ন অন্য কিছুর উপর পড়ে তখনই ঘটে বিপর্যয়।
ভূমির উপরের কোন অংশে তৈরি হওয়া ধনাত্মক আধান মেঘের ঋণাত্মক আধানকে আকৃষ্ট করে।
আর এর ফলে ভূমি সংলগ্ন যা কিছু ধনাত্মক আধান সৃষ্টিকারী বস্তু যেমন লম্বা গাছ, লম্বা ধাতব বস্তু, বা কোন মানুষ তাকে আকর্ষণ করে মেঘের নীচের দিকে থাকা ঋণাত্মক আধান।
যার ফলে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ স্ফুলিং প্রাণঘাতী হতে পারে। মেঘের উপরের এবং নীচের দুই স্তরে আধানের তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়।
এই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত আধানের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
এভাবে বাষ্পকণা ও মেঘের সংঘর্ষ চলতে চলতে মেঘের উপরে এবং নিচে যথাক্রমে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে এতটা শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরী করে যে তার বিকর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থানরত ইলেকট্রনগুলো ভূপৃষ্ঠের আরো গভীরে চলে যায়।
ফলাফলস্বরূপ ওই নির্দিষ্ট এলাকার ভূপৃষ্ঠ শক্তিশালী পজিটিভ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এখন বজ্রপাতের জন্য শুধু যা প্রয়োজন তা হল বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য সামান্য একটু বাহক বা কন্ডাক্টর।
কিন্তু আমরা জানি বাতাস বিদ্যুৎ কুপরিবাহী,তাহলে বজ্রপাত হয় কীভাবে?
মেঘের বিপুল শক্তিশালী বিদ্যুতক্ষেত্র তার চারপাশের বাতাসের কূপরিবাহী ধর্মকে নষ্ট করে দেয়,যাকে বলে অস্তরক ভাঙ্গন বা Dielectric Breakdown।
মেঘের মধ্যে অবস্থিত বিদ্যুতক্ষেত্র যখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী হয় অর্থাৎ প্রায় প্রতি ইঞ্ছিতে প্রায় ১০,০০০ ভোল্টের কাছাকাছি,তখন তার আশেপাশের বাতাস ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আধানে বিভক্ত হয়ে যায়।
বজ্রপাতের সময় যা যা করা উচিত নয়-
বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় যেমন খেলার মাঠে বা চাষের মাঠে না থাকাই উচিত। বজ্রপাতের সময় কখনোই উঁচু গাছের নীচে আশ্রয় নিতে নেই।
এছাড়াও বাড়ির ছাদে বা অন্য কোন উঁচু জায়গায় যেখানে আপনি খোলা আকাশের নীচে আছেন ,তা না করাই ভালো।
বজ্রপাতের সময় তড়িৎ পরিবাহী পদার্থ যেমন লোহা, তামা, আলুমিনিয়াম, প্রভৃতির সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ না রাখায় ভালো।
অর্থাৎ জানালার ধারে রড ধরে দাঁড়ানো বা লোহার দরজায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে না থাকা।
বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় জলের মধ্যে না থাকায় ভালো। যেমন পুকুরের মধ্যে, বা নদীতে বা সুইমিং পুলে বা সমুদ্রে।
বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎবাহী তারের কাছাকাছি বা সংস্পর্শে থাকতে নেই।
এছাড়াও বাড়িতে যেসব গ্যাজেটের সঙ্গে বৈদ্যুতিক সংযোগ থাকে তাদের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়।
যেমন ফ্রিজ, টিভি ,ডিস কানেকশন, এ সি বা আরও কিছু।
বজ্রপাতের সময় খোলা গাড়ি অর্থাৎ দুচাকা গাড়িতে না থাকাই ভালো।
বজ্রপাতের সময় বাস বা ট্রাকের মাথায় চেপে বা ট্রাক্টারের ডালায় না থাকাই উচিত।
বজ্রপাতে যা যা করতে হবে নিরাপদ থাকার জন্য-
বাড়িতে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। বাড়ির সকল বৈদ্যুতিক সংযোগের সাথে আর্থিং ব্যবস্থা করতে হবে।
সম্ভব হলে বজ্রপাতের সময় মেইন লাইনের সাথে বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখুন।
বজ্রপাতের সময় বাড়ির ভিতরে থাকতে হবে।
বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে মাটিতে উঁচু অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আবার শুয়েও পড়বেন না।
মাথা নিচু করে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে বসুন, এটাই সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি ।
বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাতের সময় সাধারণ জুতোর বদলে রাবারের জলরোধী জুতো ব্যবহার করুন।
বজ্রপাতের সময় ফাঁকা জায়গায় থাকলে একসাথে অনেকজন ভিড় করে না থেকে পরস্পর থেকে দূরে থাকুন।
বজ্রপাতের সময় মোবাইল ব্যবহার কি ঠিক ?
মোবাইলে সাধারণত ধাতুর সামান্য অংশই থাকে যদি তা বাড়ির অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করে দেখা হয়।
তবে মোবাইল টাওয়ার বেশিরভাগ লোহা বা ইস্পাতের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়ায় সেখানে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
বর্তমানে প্রায় সব মোবাইল টাওয়ারে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়।
আর মোবাইল এবং টাওয়ারের সংযোগ যেহেতু তারবিহীন তাই টাওয়ারে বজ্রপাত হলেও তা মোবাইলে প্রবাহিত হতে পারে না।
অর্থাৎ সাধারণ কথায় বলতে গেলে বজ্রপাতের সময় মোবাইল ব্যবহার বিপদজনক নয়।
ঘরের মধ্যে, রাস্তায় খোলা জায়গায় আপনি যদি বজ্রপাতের সময় মোবাইল ব্যবহার করতে থাকেন তাহলে আপনি বজ্রপাতের শিকার হতে পারেন স্বাভাবিক নিয়মে।
তবে মোবাইলের সার্কিট ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি হওয়ায় তা বজ্র আকর্ষণ করবে এরকম ধারণা করা একদম ভুল।
এছাড়াও মোবাইলে নেট সংযোগ অন থাকলে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভবনা বেশি বলে দাবি করেন অনেকে।
এই ধারণাও ভুল, যেহেতু নেটের জন্য কোন তারের মতো পরিবাহী বস্তুর সাথে মোবাইল সংযোগ করতে হয় না, তাই এইরকম ভ্রান্ত ধারণা না রাখাই ভালো।
তবে বজ্রপাতের সময় মোবাইলে বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগে চার্জ দেওয়ার সময় বজ্রাঘাতের সম্ভাবনা অনেক থাকে।
তাই এরকম কিছু কাজ করতে যাবেন না বজ্রপাতের সময়।
বজ্রপাতের সময় ওয়াই ফাই বা ইন্টারনেট ব্যবহারের ঠিক না ভুল ?
বাড়ির মধ্যে ওয়াইফাই চলে রাউটারের সাহায্যে।
এই রাউটারের সাথে যদিও বাড়ির বিদ্যুতের সরাসরি সংযোগ থাকলে, বজ্রপাতের সময় আপনার রাউটার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
কিন্তু রাউটারের সাথে ওয়াইফাই সংযোগে থাকা মোবাইল বা ল্যাপটপের ক্ষেত্রে তাদের বজ্রাঘাতে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নাই বললেই চলে।
কারণ ওয়াই ফাই একধরনের তারবিহীন সংযোগ।
তবে মনে রাখতে হবে বাড়ির বিদ্যুতের সাথে যেন ল্যাপটপ বা রাউটারের সংযোগ একদম না থাকে বজ্রপাতের সময়।
তা না হলে বিপদের সম্ভবনা বা নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
একই কথা বাড়ির ডেস্কটপ বা কম্পিউটারের ক্ষেত্রে।