বন্যার পানিতে ডুবে গেছে করটিয়া হাট; লক্ষাধিক ব্যবসায়ী বিপাকে

ইমরুল হাসান বাবু : টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাণিজ্যিক এলাকা ঐতিহ্যবাহী করটিয়া কাপড়ের হাট ভাসছে বন্যার পানিতে। এতে করে রাজস্ব আদায় বন্ধ রয়েছে। বৃহস্পতিবার (৬ আগস্ট) সকালে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রটি দেখা যায়। এতে বিপাকে পড়েছে পাইকারী বিক্রেতা ও স্থানীয় ইজারাদার।

জানা যায়, টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে করটিয়া হাটের ইতিহাস। প্রায় দু’শ বছর এর বয়স বলে জনশ্রুতি আছে। প্রবীণ শাড়ি ব্যবসায়ী রঘুনাথ বসাক জানান, প্রাচীনকালে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মসলিন শাড়ি বুনতেন বলে শোনা যায়। এর স্বার্থক উত্তরাধিকারী হয়ে আজও টিকে রয়েছে টাঙ্গাইলের জামদানি, বেনারসি ও তাঁতের শাড়ি। অতীতে মুসলমান তাঁতিদের বলা হতো ‘জোলা’। জোলাদের সংখ্যাধিক্য ছিল টাঙ্গাইল শহর, কালিহাতী ও গোপালপুর এলাকায়। অপরদিকে যুগী বা যুঙ্গীদের নাথপন্থী ও কৌলিক উপাধি হিসেবে দেবনাথ বলা হয়। ক্ষৌম বস্ত্র বো মোটা কাপড় বোনার কাজে এদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। সুতা কাটার চরকা ছিল তাদের। পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই সুতা কাটা ও কাপড় বুনতেন। যুগীরা ক্ষৌম, গামছা, মশারি তৈরি করে প্রায় স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতেন। আরও জানা যায়, টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিদের মৌলিক উপাধি বসাক। বাজিতপুর ও নলসুন্দা গ্রামেই তাদের অনেকে বাস করেন। তবে বল্লা ও রতনগঞ্জে জোলার সংখ্যা বেশি।

দেশ ভাগের আগে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বাজার বসতো কলকাতায়। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা চারাবাড়ি, পোড়াবাড়ি ও নলছিয়া ঘাট এবং সুবর্ণখালী বন্দর থেকে স্টিমার, লঞ্চ ও জাহাজে চড়ে কলকাতায় যেতেন। দেশ ভাগের পর টাঙ্গাইল তাঁতের প্রধান হাট ছিল জেলার বাজিতপুরে। শুধু দেশি পাইকাররাই নন, ভারত ও ইংল্যান্ড থেকেও শাড়ি কিনতে আসতেন ক্রেতারা। টাঙ্গাইল শাড়ির এমন চাহিদা আর দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের আগমন দেখে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত করটিয়া জমিদার পরিবার একটি হাটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পন্নী পরিবারের সদস্য ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়া করটিয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে একটি হাট নির্মাণ করেন। সে সময় করটিয়া ছিল একটি নদীবন্দর। সেখানে সপ্তাহজুড়ে হাট বসতো।

প্রায় দুইশ বিঘা জমির ওপর হাটটি প্রতিষ্ঠিত। লক্ষাধিক ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন এখানে। শাড়ির পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাস-মুরগি, ধান-পাট সহ সকল প্রকার নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর জন্যও বিখ্যাত এ হাট। এখান থেকেই অনেক জেলার কারিগরের তৈরি চাদর ভারত, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ও কয়েকটি শীত প্রধান দেশে রফতানি হয়।

বর্তমানে সপ্তাহে দু’দিন বসে হাটটি। সপ্তাহের মঙ্গলবার বিকালে শুরু হয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে শেষ হয়। দেশের নানা স্থান থেকে আসা পাইকাররা এখানের শাড়ি কিনে খুচরা বিক্রি করেন। সপ্তাহে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় এখানে। খোলা মাঠে শাড়ি বিক্রির পাশাপাশি হাটে তৈরি করা হয়েছে অর্ধশতাধিক বহুতল মার্কেট। টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি প্রিন্টের শাড়িও পাওয়া যায় এখানে। ঢাকার ইসলামপুর, নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও এনায়েতপুর থেকে শাড়ি আসে। বর্তমানে শাড়ি ও শালের পাশাপাশি লুঙ্গি, চাদর, থ্রিপিস এবং শিশুদের পোশাক পাওয়া যায় এখানে। পাইকারির পাশাপাশি চলে খুচরা বিক্রিও।

জানা যায়, চলতি বছরে প্রায় ১ কোটি ৭২ লাখ টাকা হাটের ইজারা নেয় দীবা এন্টারপ্রাইজ।

এ বিষয়ে কাপড় বিক্রেতা আমিনুর, রফিক, করিম, উজ্জল, জানান, করটিয়া হাটে পানি উঠায় আমরা বিকিকিনি করতে পারছি না। ঐতিহ্যবাহী এ হাটটি স্বাধীনতার পর চোখে পড়ার মত কোন উন্নয়ন হয়নি। উন্নয়নের দাবিও জানান তারা।

হাটের স্থানীয় ইজারাদার নুরুল আমিন জানান, করোনা ও বন্যার কারণে তিন মাস যাবত হাটে কোন মহাজন আসতে না পারায় খাজনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সায়েদুল ইসলাম বলেন, করটিয়া হাটের এ সংকটের কথা আমি শুনেছি। এই হাটের ঐতিহ্যের কথাও আমি জানি। হাটটির উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠাবো, যাতে ভবিষ্যতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।