ব্যাপক আলোচনায় থাকলেও কমিটিতে নেই মুরাদ সিদ্দিকী! কেন?

ব্যাপক আলোচনায় থাকলেও কমিটিতে নেই মুরাদ সিদ্দিকী

অলক কুমার : টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি চুড়ান্ত করা হয়েছে।

কিন্তু সেই কমিটিতে নেই টাঙ্গাইলের ব্যাপক আলোচিত সিদ্দিকী পরিবারের সন্তান মুরাদ সিদ্দিকী। দলের একাধিক সিনিয়র নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এনিয়ে টাঙ্গাইলের সর্বমহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা আর সমালোচনার ঝড়।

দলীয় সূত্র থেকে পাওয়া :

জেলা আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নতুন কমিটিতে মুরাদ সিদ্দিকীর অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ব্যাপক গুঞ্জন চলছিল; এ বিষয়ে কেন্দ্রের সবুজ সংকেতও ছিল।

কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগে মুরাদ সিদ্দিকীর অন্তর্ভূক্তির বিষয়ে জেলা কমিটির কোন সুপারিশ ছিলো না।

সূত্রটি নিশ্চিত করেছেন যে, জেলার কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও ৩/৪ জন সংসদ সদস্য তাঁকে দলে নেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন।

দলীয় সূত্রটি জানায়, মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের ঢাকার বাসায় বৈঠকে জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি চুড়ান্ত করা হয়।

রুদ্ধদ্বার ওই বৈঠকে আব্দুর রাজ্জাক ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ও সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম অংশ নেন।

বৈঠক চলার সময় আব্দুর রাজ্জাকের বাসভবনে জেলার বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

জেলা আওয়ামী লীগের ৮/১০ জন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কমিটি চুড়ান্ত করার সময় মুরাদ সিদ্দিকীকে কমিটিতে রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়।

সেখানে জেলার কোন নেতা যেমন মুরাদ সিদ্দিকীর নাম সুপারিশ করেননি, তেমনি মন্ত্রীও কোন মতামত দেননি।

পরে তারা সিদ্ধান্ত নেন, দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

পরবর্তীতে মুরাদ সিদ্দিকীর নাম বাদ দিয়েই কমিটি চুড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

দলের নেতার বক্তব্য –

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই জন সিনিয়র নেতা জানান, মুরাদ সিদ্দিকী বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান আবদুল কাদের সিদ্দিকী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সাবেক সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ভাই।

মুরাদ সিদ্দিকীকে দলে নিলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগেরই লাভ হতো। মুরাদ সিদ্দিকী জনপ্রিয় নেতা।

জানা যায়, ১৯৯৯ সালে আবদুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ ছেড়ে কৃষক শ্রমিক জনতালীগ নামে নতুন একটি দল গঠন করেন।

মুরাদ সিদ্দিকী তখন ভাই কাদের সিদ্দিকীর দলে যোগ না দিলেও দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন।

এরপর ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী হিসেবে টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুরাদ সিদ্দিকী।

এরপর ২০০৯ সাল থেকে মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

পরবর্তীতে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের রাজনীতি থেকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যান তিনি।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি টাঙ্গাইল-৫ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

এদিকে, ২০০৯ সাল থেকে মুরাদ সিদ্দিকী জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন।

২০১৫ সালে মুরাদ সিদ্দিকীর অনুসারী টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান মিরনসহ একাধিক নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

তারা পরবর্তী সময়ে জেলা আওয়ামী লীগে পদ-পদবিও পান। কিন্তু মুরাদ সিদ্দিকীকে দলে নেয়া হয় না। তা সত্তে¡ও তিনি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচি এবং দলীয় কার্যালয়ে যাতায়াত অব্যাহত রাখেন।

সম্প্রতি টাঙ্গাইল রাইফেল ক্লাবে আয়োজিত জেলা আওয়ামী লীগের মিলাদ মাহফিলে বিশেষ অতিথি হিসেবেও উপস্থিত ছিলেন মুরাদ সিদ্দিকী।

গত বছরের ৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মুরাদ সিদ্দিকী একটি বিশাল মিছিল নিয়ে অংশ নেন।

সেদিন আওয়ামী লীগে অন্তর্ভূক্তির শর্তে মুরাদ সিদ্দিকীর ওপর সম্মেলনের একটি বড় ব্যয় চাপিয়ে দেয়া হয় বলেও দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খানকে সভাপতি এবং টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

তখন থেকেই গুঞ্জন উঠেছে মুরাদ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন।

দলের অন্যান্য নেতাদের কথা –

এবিষয়ে দলের মাঝারি পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেন, মুরাদ সিদ্দিকী যেন দলে প্রবেশ করতে না পারেন, সেজন্য সম্মেলনের পর থেকে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা এবং তিনজন সংসদ সদস্য উঠে পড়ে লেগেছেন।

তবে সেখানে জেলার উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সমর্থন ছিলো।

জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে জেলার নেতাদের বলা হয়েছে মুরাদ সিদ্দিকীকে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে রাখার জন্য।

কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ এবং অন্তত চার জন সংসদ সদস্য চান না মুরাদ সিদ্দিকী যেন আওয়ামী লীগে প্রবেশ করতে না পারে।

তিনি দলে এলে টাঙ্গাইল সদর অথবা কালিহাতী আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন।

এ জন্য সংশ্লিষ্ট আসন দুটির বর্তমান সংসদ সদস্যদের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে।

ফলে মুরাদ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগে অন্তর্ভূক্ত না করতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন ওই অংশটি।

অন্যান্য বিষয় –

এদিকে, গত ২৩ ডিসেম্বর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী স্বপরিবারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার পর থেকে মুরাদ সিদ্দিকীর বিষয়টি জোড়ালো ভাবে আলোচনায় আসে।

এছাড়াও কাদের সিদ্দিকী তার মেয়ে কুড়ি সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের বিভিন্ন এলাকায় জনমত গঠন করতে পথসভা করে যাচ্ছেন।

গত ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে একটি অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়কমন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস এমপি, আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী বহিস্কৃত নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে এক মঞ্চে উঠেন।

এরপর থেকে সিদ্দিকী পরিবার পূণরায় আলোচনায় উঠে আসেন।

এবিষয়ে মুরাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই আছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে আওয়ামী রাজনীতি করছি।

জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের নিয়ে যোগ দিচ্ছি। সব সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবো।

টাঙ্গাইল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘মুরাদ সিদ্দিকীকে দলে নেওযার ব্যাপারে আমার কাছে কোনও তথ্য নেই।

এটা নীতি নির্ধারকদের ব্যাপার। দলে নেওয়ার আগে এব্যাপারে আমার কোনও মন্তব্যও নেই। দলে নেওয়া হলে আমার প্রতিক্রিয়া জানাবো।’

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক দফতর সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দেওয়ার জন্য খসড়া তৈরি হয়েছে।

মুরাদ সিদ্দিকীর বিষয়ে জানা নেই। কমিটি এখন পর্যন্ত নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমার বিষয়টি জানা নেই। খুব দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে।

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম (ভিপি জোয়াহের)এর কোন মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।