শুভ মহালয়ায় পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের শুরু

বিশেষ প্রতিবেদক : শুভ মহালয়ায় পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের শুরু। একই সঙ্গে শারদীয় দুর্গোৎসবের পুণ্যলগ্নেরও শুরু।

মহালয়ার মাধ্যমে দেবী দুর্গা আজ পা রেখেছেন মর্ত্যলোকে। বছর ঘুরে আবারও উমা দেবী আসছেন তার বাপের বাড়ি।

পুরাণমতে, অশুভ অসুর শক্তির কাছে পরাভূত দেবতারা স্বর্গলোকচ্যুত হওয়ার পর চারদিকে শুরু হয় অশুভ শক্তির প্রতাপ।

এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে একত্র হন দেবতারা। তখন দেবতাদের তেজরশ্মি থেকে আবির্ভূত হন অসুরবিনাশী দেবী দুর্গা।

মহালয়ার সময় ঘোর অমাবস্যা থাকে। তখন দুর্গা দেবীর মহাতেজের আলোয় সেই অমাবস্যা দূর হয়। প্রতিষ্ঠা পায় শুভশক্তি।

শাস্ত্রমতে, হিমালয়ের কৈলাশ থেকে সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিবছর দুর্গা দেবী আসেন সমতল ভূমির মর্ত্যে। সঙ্গে নিয়ে আসেন গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী আর সরস্বতীকে।

প্রতিবছরের শরৎকালে দেবী দুর্গার এই আগমন হয় নিজ ভূমিতে।

বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, এবার দুর্গা দেবী আসছেন ‘দোলায়’ –

ফল – “দোলাং মড়কাং ভবেৎ৷ অর্থাৎ দেবী দুর্গা যদি দোলায় চড়ে গমনাগমন করেন তার ফল মর্ত্যে বহু মৄত্যু৷ এই বহু মৄত্যু হতে পারে প্রাকৄতিক দুর্যোগের কারণে কিংবা যুদ্ধ হানাহানির কারণে৷

দোলা হল পালকির মতো একটি যান৷ যার স্থিরতা কম, সদা দলুল্যমান, অল্পে ভঙ্গুর এবং অনেক সময়ই বিপদের কারণ ৷

তাই দুর্গার দোলায় গমনাগমনই মর্ত্যভূমির স্থিরতা ব্যাহত হতেই পারে৷ দুর্গা যদি বৄহস্পতিবার বা শুক্রবার গমনাগমন করেন, তাহলে তাঁর যানবাহন হয় দোলা৷

সূত্র ধরে বিচার করা যেতে পারে – দেবগুরু বৄহস্পতি হলেন বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং চিন্তাশীল ৷ ফলে ভবিষ্যতের ভালোমন্দ ভাবতে তিনি এতটাই বিভোর হয়ে পড়েন যে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নিয়ে নেন ৷

শাস্ত্র বলে, অতি বিলম্বের ফল ভালো হয় না, বিহুবিধ বিঘ্ন-বিভ্রাট এসে উপস্থিত হয় ৷ অন্যদিকে শুক্রাচার্য হলেন দৈত্য গুরু ৷ তিনিও বিদ্বান ও তেজস্বী৷

কিন্তু, তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ এতটাই দ্রুততার সঙ্গে হয় যে প্রায়শই তাঁকে সমস্যায় পড়তে হয় ৷

অতিবিলম্বের সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন সুফল দেয় না, তেমনই অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণও কুফলের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ৷

আর এই গুরুর চারিত্রিক প্রভাবে প্রভাবিত হয় দেবীর গমনাগমন এবং দুর্গার দোলায় যাতায়াতের ফলে মর্ত্যলোকে নষ্ট হয় স্থিরতা, ঘটে বহু মৄত্যু ৷

এবার দেবীর গমন করবেন ‘গজে’ –

শাস্ত্র বলে – ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’৷ অর্থাৎ দেবী যদি গজে গমনাগমন করেন তাহলে পৄথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে এবং শস্য ফলন ভালো হয় ৷ সুখ সমৄদ্ধিতে পরিপূর্ণ থাকে মর্ত্যভূমি ৷

পার্থিব সম্পদের মধ্যে ‘গজ’ হল বড় সম্পদ৷ প্রাচীনকালে রাজা মহারাজাদের বৈভব মাপা হত হাতিশালের হাতির সংখ্যা বিচার করে৷ তাই ‘গজ’ হল সমৄদ্ধির প্রতীক৷

অন্যদিকে হাতি হল অন্নপূর্ণা এবং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার বাহন৷ অন্নপূর্ণার আশির্বাদে শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে এই বসুন্ধরা৷

শস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন পরিমিত জল৷ অন্যদিকে কৄষিকাজের পাশাপাশি প্রয়োজন শিল্পের৷

বিশ্বকর্মার বাহন যেমন গজ তাই, তেমনই বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের দেবতা৷

তাই গজে গমনাগমনের ফলে পৄথিবীতে কৄষিকাজের পাশাপাশি শিল্পের উন্নতি ও প্রসার হয়৷ আবার বৄহস্পতিবার লক্ষ্মী পুজোর শ্রেষ্ঠ দিন৷

কিন্তু শাস্ত্রমতে বৄহস্পতিবার লক্ষ্মী পুজোর যোগ্য তিথি-নক্ষত্র যুক্ত রবি বা সোমবার লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা যেতে পারে৷

সুতরাং, বলা যায় রবিবার ও সোমবার হল ধনসম্পদ লাভের উত্তম দিন৷

সবদিক বিচার করলে দেখা যাচ্ছে দেবী দুর্গার গজে গমনাগমনের শাস্ত্রীয় ফলাফল কল্পনাপ্রসূত নয় ৷ যথেষ্টই যুক্তি সংগত ৷

হিন্দু শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া হিসেবে পরিচিত।

মহালয়া দুর্গোৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও মূলত আজ থেকেই পূজারীরা দুর্গা মায়ের আগমন ধ্বনি শুনতে পাবেন।

হিন্দু ধর্মমতে, মহালয়ার দিনে দেব-দেবীকুল দুর্গাপূজার জন্য নিজেদের জাগ্রত করেন।

শাস্ত্রীয় বিধান মতে, মহালয়ার দু’টি পর্ব রয়েছে, একটি পিতৃপক্ষ, অন্যটি দেবীপক্ষ।

অমাবস্যা তিথিতে পিতৃপক্ষের শেষ হয়, আর প্রতিপদ তিথিতে শুরু হয় দেবী পক্ষের। মহালয়া দিয়ে আরম্ভ হচ্ছে সেই দেবীপক্ষ।

এদিন গঙ্গাতীরে প্রার্থনা করে ভক্তরা মৃত আত্মীয়স্বজন ও পূর্বপুরুষদের আত্মার মঙ্গল কামনা করেন।

ভোর থেকে সারাদেশে স্থায়ী অস্থায়ী দুর্গা মণ্ডপগুলোতে চণ্ডীপাঠ ও পূজা অর্চনার মাধ্যমে দুর্গা দেবীকে আহ্বান করা হয়। এভাবেই আজ মর্ত্যলোকে, আবাহন ঘটে দেবী দুর্গার।

ভক্তদের কন্ঠে উচ্চারিত হবে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা, নমস্ত্যৈ নমস্ত্যৈ নমস্ত্যৈ নমোঃ নমঃ’।

বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, এবার ৪ কার্তিক (২১ অক্টোবর) সায়ংকালে দেবীর বোধন হবে।

এরপর ৫ কার্তিক (২২ অক্টোবর) ষষ্ঠীবিহীত পূজা অনুষ্ঠিত হবে।

পর্যায়ক্রমে ৬ কার্তিক (২৩ অক্টোবর) মহাসপ্তমী, ৭ কার্তিক (২৪ অক্টোবর) মহাষ্টমী, ৮ কার্তিক (২৫ অক্টোবর) মহানবমী এবং ৯ কার্তিক (২৬ অক্টোবর) বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে এই মহানুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে।

এদিকে মহালয়ার মাধ্যমে দুর্গাপূজার আবহ শুরু হয়েছে।

তাই চারদিকে আনন্দ আয়োজন সম্পন্ন করার তাড়া এখন সবার। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।

খুশির আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে, সব বয়সী মানুষের মনে।

এ উপলক্ষে সারা দেশে নেয়া হচ্ছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

আজ শুভ মহালয়া উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে মহালয়ার বিশেষ অনুষ্ঠিত হয়।

ঘট স্থাপন, চণ্ডীপাঠ, পূজা অর্চনা, আরাধনাসহ এ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

এছাড়া সারা দেশের স্থায়ী, অস্থায়ী পূজামণ্ডপগুলোতে মহালয়া উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।