ফেরদৌস খান বিদ্যুৎ –
মাফিয়া সরকারের ১৬ বছরের শোষণ, বঞ্চনা, মুক ও বধির হয়ে থাকার দীর্ঘ হাপিত্যেশ।
নতুন জাগরণের ছাত্র-জনতার বিজয় ছিনিয়ে আনার গল্প লিখে শব্দ বাড়াতে চাইনা।
তবে বিজয় এর পর বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার কৌশল এ শত্রুরা কি করতে পারে তার উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি এই লেখায়।
আরো পড়ুন – গত ১৫ বছরের সব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে, সাবভার্সন বা সমাজকে ভেতর থেকে দুর্বল করে ফেলার পদ্ধতি হিসেবে ডিভাইড অ্যান্ড রুলস নীতি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
ব্রিটিশরা যেভাবে করতো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়ে এসে হয়তো সেটিকেই ফিরিয়ে আনা হয়েছে নতুন আঙ্গিকে, নতুন রুপে।
এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য সমাজের দুর্বল, প্রান্তিক এবং অশিক্ষিত শ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে একটি অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।
এই নীতির কার্যকারিতা কতটা বিস্তৃত এবং বিপজ্জনক, তা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর উপর এর প্রভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়।
১. নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী :
বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণী, বিশেষ করে রিকশা চালক, সিএনজি চালক এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষরা, সমাজের সেই শ্রেণী যারা প্রতিনিয়ত জীবনের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং অশিক্ষার কারণে তারা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির গভীরতা বুঝতে অক্ষম।
এই শ্রেণীর মানুষেরা সহজেই অর্থনৈতিক প্রলোভন বা ক্ষুদ্র সুবিধার বিনিময়ে রাস্তায় নামতে প্রস্তুত হয়।
রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীস্বার্থে এদের ব্যবহার করা খুব সহজ, কারণ তাদের জীবনের অবস্থা অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
আরো পড়ুন – দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার ও কালোটাকা উদ্ধারে শিগগিরই যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান
সাবভার্সনের প্রক্রিয়ায় এদের ব্যবহার করতে হলে প্রথমে এদের মধ্যে ভিন্নমত, অসন্তোষ এবং বিভাজন সৃষ্টি করা হবে বা হচ্ছে।
এরপর কিছু স্থানীয় নেতা বা এজেন্টের মাধ্যমে তাদের স্বার্থের নামে সংঘবদ্ধ করা হয়, যা মূলত বৃহত্তর একটি পরিকল্পনার অংশ।
যেমন সাম্প্রতিক সময়ে রিকশা চালকদের আন্দোলনের ঘটনাটি এই প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ হতে পারে। আনসার বিদ্রোহকেও এর উদাহরণ টানা যেতে পারে।
২. ছাত্র সমাজ এবং তরুণ প্রজন্ম :
ছাত্র সমাজ বাংলাদেশে সবসময়ই একটি শক্তিশালী এবং সচেতন গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত।
তবে, সাবভার্সনের পদ্ধতিতে এই গোষ্ঠীকে বিভিন্ন উপায়ে বিভক্ত করা এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়।
ছাত্রদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের একটি অংশকে ব্যবহার করা, এবং অন্য অংশকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা, খুবই চতুরভাবে সম্পাদিত হয়।
ফলে একটি স্থিতিশীল আন্দোলনও সহজেই বিশৃঙ্খলায় রূপ নিতে পারে।
যার উদাহরণ ধরা যায় এইচএসসি পরীক্ষা বন্ধের নামে আন্দোলন করে কিছু ছাত্রের সচিবালয়ে ঢুকে যাওয়া এবং সচিবালয় থেকে পরীক্ষা বন্ধের নির্দেশ নিয়ে আসা।
অন্যদিকে এর বিপক্ষেই মেধাবী ছাত্রদের অবস্থান নেয়া।
৩. ধর্মীয় ডিভাইড অ্যান্ড রুলস এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন :
বাংলাদেশে ধর্মীয় বিভাজনও সাবভার্সন পদ্ধতির একটি গুরুতর অংশ।
হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা মন্দির ভাঙচুরের মতো ঘটনা প্রায়শই রাজনৈতিক ও সামাজিক অসন্তোষকে উস্কে দিতে ব্যবহৃত হয়।
এই ধরনের ঘটনা সমাজে ভয়, সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করে, যা একটি স্থিতিশীল সমাজকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
আরো পড়ুন – সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চাঁদাবাজির টাকা জমা রাখতো বড়মনি
যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়, সেটি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং অনেক সময় পরিকল্পিতভাবে সমাজের একাংশকে আক্রমণের শিকার বানানো হয়।
এ ধরনের ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে দুর্বল করা এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করা।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ৫ আগষ্ট এর বিজয় এর পর সারাদেশ এ হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে এই মর্মে ভারতীয় প্রপাগান্ডা এবং শাহবাগের হিন্দু ব্যানার এ আন্দোলন। যা আমাদের হিন্দু-মুসলিম ভাই-বোন মিলে ধ্বংস করেছে।
৪. মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী/এবং সরকারী বেসরকারি কর্মকর্তা শ্রেণী :
মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণী সাধারণত সমাজের মেরুদন্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই শ্রেনী সরকারী কর্মচারী অথবা বেসরকারি চাকুরি শ্রেনী এদের মধ্যে সাবভার্সনের জন্য বিশ্লেষণধর্মী প্রচার, গুজব এবং তথ্য বিকৃতি ব্যবহার করা হয়।
এসব শ্রেণীর মানুষদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা, ভয় এবং অবিশ্বাসের বীজ বপন করা হয়।
ফলে তারা সামগ্রিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠে, যা সমাজেকে অস্থিরতার দিকে নিয়ে যায়।
প্রতিটি চাকরিজীবীর ভিতর এখন কাজ করছে বিগত দিনের ভূমিকায় আমার এখন ভবিষ্যৎ কি হবে? এ শ্রেণির উদাহরণ আপনাদের চোখের সামনে।
৫. সরকারের ভূমিকা এবং সাবধানতা :
সরকারের পক্ষ থেকে এই সাবভার্সন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
এটি মোকাবেলার জন্য কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর নির্ভর না করে, সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর সাথে সঠিক যোগাযোগ স্থাপন করা এবং তাদের বিশ্বাস অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে ছাত্র সমাজ, নিম্নবিত্ত শ্রেণী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মাঝে সরকারের সঠিক অবস্থান এবং কার্যক্রম প্রচার করা প্রয়োজন।
এর সাথে অপরাধের বিচার দ্রুততার সাথে করা। অপরাধীদের আইন এর মধ্য থেকেই আইন এ সোপর্দ করা।
কোনো অপরাধীর গায়ে যেনো হাত না তুলতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
শ্রেণি বিভাজন রোধের উপায় :
সাবভার্সন এবং ডিভাইড অ্যান্ড রুলস নীতির মাধ্যমে সমাজকে ভাঙনের পথে ঠেলে দেয়া যায়, যদি না সরকার এবং জনগণ সচেতনতার সাথে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
সমাজের প্রতিটি শ্রেণীই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের একতাবদ্ধ রাখা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
এ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং মানুষের মাঝে বিশ্বাস স্থাপন করাই হতে পারে অস্থিতিশীলতা রোধের মূলমন্ত্র।
বিশেষ করে ধর্মীয় বিভাজনের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে সরকারকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোনো ষড়যন্ত্র সফল না হতে পারে।