নিজস্ব প্রতিবেদক : টাঙ্গাইলের কালিহাতীর উপজেলার এলেঙ্গায় জনবসতিপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছে একাধিক ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরির একাধিক অবৈধ কারখানা।
কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া আর রাসায়নিক পদার্থে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য চরম হুমকিতে পড়েছে; কিন্তু অজানা কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর এ বিষয়ে নিরব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেও ফল পাচ্ছেন না অসহায় ভুক্তভোগীরা। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন জেলা প্রশাসক।
সরেজমিনে দেখা যায় –
ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এলেঙ্গা পৌরসভাধীন পুংলী নদীর উত্তর পাশে ছায়া নিবিড় ছবির মতো গ্রামটির নাম ফটিকজানী।
এ গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই দীর্ঘ ৫ বছর ধরে শাপলা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের কারখানায় দিনরাত ২৪ ঘন্টা চলে ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরির কাজ।
কারখানায় প্রতিনিয়ত ১০/১২ জন শ্রমিক কাজ করেন। চুল্লির মধ্যে এসিড মিশ্রিত ব্যাটারির বর্জ্য সাজানো আছে; এরপর আগুন দিয়ে তা গলাচ্ছে।
পাশেই বৈদ্যুতিক পাখা থেকে বাতাস দেওয়া হচ্ছে। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সিসা তৈরি হচ্ছে।
এ সীসা কারখানার বিষাক্ত এসিড ও ধোঁয়ায় আশেপাশের গাছপালা মরে যাচ্ছে। ক্ষেতে ধানের বদলে হচ্ছে চিটা।
গ্রামের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন জটিল রোগ ব্যাধি।
ভূক্তভোগীদের কথা –
ভুক্তভোগী গ্রামবাসী আর্তনাদ করে বলেন, এ কারখানার স্বত্ত্বাধিকারী আলা উদ্দিন অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পর্যন্ত পায় না। লিখিত অভিযোগ করেও হয় না কোন কাজ।
ফটিকজানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফরিদা খাতুন বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ২০০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে।
এ সীসা কারখানার ফলে স্কুলের বাচ্চাসহ এলাকার মানুষের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
ফটিকজানী গ্রামের আব্দুস সামাদ বলেন, আমার ৫১ শতাংশ জমিতে শুধু ঘাস হয়, ধান হয় না।
২০২২ সালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট এ ক্ষতিকর কারখানা বন্ধের জন্য একটি আবেদন করেছিলাম। কিন্তু মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় কোন ব্যবস্থা হয়নি।
বাবুল মিয়া বলেন, এ সীসা কারখানার ফলে আমার ছেলে প্রতিমাসেই ৩/৪ বার অসুস্থ হয়ে পড়ে; সাথে আমার স্ত্রীও অসুস্থ। ধান ক্ষেতের স্ক্রীমের মালিক জমিতে ধান না হওয়ার কারণে স্ক্রীম বন্ধ করে দিয়েছেন।
চিকিৎসকের কথা –
স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক জাকির হোসেন বলেন, কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া কুয়াশার মতো এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়ায় ঠান্ডাকাশিজনিত রোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে।
গাছের ফল পড়ে যায় ও ধানের ফলন কম হয়। সুলতান মাহমুসহ এলাকাবাসী এ সীসা কারখানা বন্ধের জোর দাবি করেছেন।
মালিক পক্ষের কথা –
তবে শাপলা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্ত্বাধিকারী বলেন, আমি কাগজপত্র নিয়েই কারখানা পরিচালনা করছি। এলাকার মানুষের কোন সমস্যা অসুবিধা হয় না।
এদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের কোল ঘেঁষেই পৌলী এলাকায় গড়ে উঠেছে পমিজান মেটাল নামের অবৈধ সিসা তৈরি কারখানা।
কারখানা সংলগ্ন মহাসড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। ব্যাটারির অ্যাসিডের গন্ধ আর ধোঁয়ায় স্থানীয় লোকজন অতিষ্ঠ।
স্থানীয়রা জানান, পৌলী নদীর পাশে গড়ে উঠা এ কারখানাটি বন্ধের দাবিকারীরা নানাভাবে হুমকি-ধমকি শিকার হন।
রাত দিন এই অবৈধ কারখানা চলার কারনে পরিবেশ ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
পমিজান মেটালের ম্যানেজার তানভীর আহমেদ চান মিয়া বলেন, বগুড়ার মোশারফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি এ কারখানার মালিক।
তারা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সবাইকে ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন ধরে এটা চালাচ্ছেন। তাই কোন অভিযান হয় না।
এছাড়া এলেঙ্গা বাজারের পাশেই রয়েছে আরেকটি সীসা কারখানা।
ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিবেশবাদীদের কথা –
সীসা কারখানার এক কর্মচারী বলেন, ব্যাটারি বর্জ্য বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকযোগে কারখানায় আনা হয়।
তিন মণ বর্জ্য থেকে দেড় থেকে দুই মণ সিসা তৈরি হয়। এখানে কাজ করার ফলে অনেক সময় শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। মাঝে মাঝে শরীরও চুলকায়।
পৌলী এলাকার বাসিন্দারা বলেন, ‘সিসা ফ্যাক্টরির কারণে গাছপালার পাতা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। নানা রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে।’
যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা বলেন, মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াত করার সময় পৌলী এলাকায় আসলে গ্যাসের গন্ধে নাক ও চোখ জ্বলে।
এবিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সবুজ পৃথিবীর’ সাধারণ সম্পাদক শহীদ মাহমুদ জানান, ব্যাটারি বর্জ্য পোড়ানোর সময় যে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়, তার গাড়ির ধোঁয়ার চেয়েও মারাত্বক ক্ষতিকর।
এটা মানবদেহ, জীব-বৈচিত্র ও পরিবেশের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ স্থানয়ি প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য –
টাঙ্গাইল সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. শিমু সাহা বলেন, সীসা একটি ধাতু। সীসা মানব শরীরে প্রবেশ করলে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে।
৬ বছরের নীচের শিশুরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর ফলে মানসিক বিকৃতি, রক্তশূন্যতা ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। সিসা কারখানার নির্গত গ্যাস মানুুষের শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কোনো পশু পাখি কারখানার আশপাশের ঘাস খেলে অসুস্থ কিংবা মারাও যেতে পারে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সীসা তৈরির বিষয়টি পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
যার কারনে মাটি ও পানি দুষিত হচ্ছে। অবৈধভাবে চলমান কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আমরা দীর্ঘ মেয়াদে চরম ঝুঁকিতে পড়বো।
কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুসেইন বলেন, অবৈধ সীসা কারখানার বিষয়ে কোন তথ্য আমার জানা ছিল না; বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমীর উদ্দীন বলেন, ব্যাটারি পুড়িয়ে অবৈধ সীসা কারখানাগুলো পরিবেশের ক্ষতি সাধন করছে কি না সেটা পরিদর্শন করে জানতে হবে।
জনবসতির মধ্যে কিভাবে শাপলা মেটাল ইন্ডাস্ট্রি ও পমিজান মেটাল সীসা কারখানা পরিচালনা করছে এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন পরিবেশ এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকর এমন অবৈধ সীসা করাখানার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।