হেমায়েত হোসেন হিমু : ২৬ আগস্ট বুধবার, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ট্রাজেডি দিবস। ২০০৬ সালের এই দিনে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনি বাস্তবায়নের প্রতিবাদে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক গণআন্দোলন। ঘেরাও করা হয় এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস। এ সময় তৎকালীন বিডিআর ও পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামসহ আমিন ও সালেকিন নামের তিন যুবক প্রাণ হারান। আহত হন প্রায় দুই শতাধিক নারী-পুরুষ।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস-এর এই দিনটিকে ‘ফুলবাড়ী দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে ফুলবাড়ীবাসী ও তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। দিবসটি পালন উপলক্ষে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন ও ফুলবাড়ীবাসীর পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
গণআন্দোলনের ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে সম্পাদিত ৬ দফা চুক্তি। উল্টো এশিয়া এনার্জির দায়ের করা একাধিক মামলা আন্দোলনকারী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মাথার ওপর চেপে বসেছে।
২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি বাস্তবায়নের প্রস্তাবকারী বহুজাতিক কোম্পানি এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ীর অফিস ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিছিলের ওপর টিয়ার শেল ও গুলিবর্ষণ করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামসহ আমিন ও সালেকিন নামে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন মিছিলে অংশ নেওয়া অনেকেই। পঙ্গুত্ব বরণ করেন বাবলু রায়ের মত অনেকেই। গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই দিনের পর থেকে মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে ছিলেন সাহাবাজপুরের প্রদীপ সরকার। অবশেষে গত সাত মাস আগে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। এখনও অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছেন গুলির ক্ষত।
জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী খনির কয়লা তোলার চক্রান্ত বন্ধের দাবিতে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ওইদিন বহুজাতিক কোম্পানী এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দিয়েছিল। এই কর্মসূচিকে সমর্থন করে আন্দোলনে যোগ দেয় ফুলবাড়ী সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন। কয়লাখনি এলাকা ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ এই চার উপজেলার হাজার হাজার মানুষ দলবদ্ধ হয়ে সেদিন বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এশিয়া এনাজির কার্যালয় ঘেরাও করতে যায়। ফুলবাড়ী ছোট যমুনা সেতুর পূর্ব পাশে পুলিশ-বিডিআর ওই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই তিন যুবক নিহত হলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য হরতালসহ অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। ২৬ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট বিকেল পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ফুলবাড়ী।
টানা চার দিনের গণআন্দোলনের মুখে ৩০ আগস্ট তৎকালীন সরকার ফুলবাড়ীবাসীর সঙ্গে ৬ দফা শর্তে সমঝোতা চুক্তি করে। ঐদিন সন্ধ্যায় পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে তৎকালীন বিএনপি- জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের সাথে আন্দোলনকারীদের ৬ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা চুক্তিতে সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এবং আন্দোলনকারীদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তেল গ্যাস জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
৬ দফা দাবিগুলো হচ্ছে : এশিয়া এনার্জিকে (জিসিএম) দেশ থেকে বহিষ্কার এবং এর সুবিধাভোগী দালালদের বিচারসহ বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লাখনি করার চক্রান্ত বন্ধ করা, ফুলবাড়ী কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা চুরি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি এবং দেশি খনি শ্রমিকদের চাকরির জটিলতা নিরসনসহ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করা, বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আন্দোলনরত শ্রমিকদের দ্রুত নিয়োগ দেয়া, রামপাল-রূপপুরসহ প্রাণবিনাশী স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করে করোনা মোকাবেলায় সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ দেওয়া এবং ফুলবাড়ী-খয়েরপুকুর সড়কের বড়পুকুরিয়া এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার দ্রুত সংস্কার করে চলাচলের উপযোগী করা।
সমঝোতা চুক্তির আংশিক সরকার বাস্তবায়ন করলেও এখন রয়ে গেছে এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে বহিস্কার, দেশের কোথাও কোন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি বাস্তবায়ন না করার মতো বেশ কয়েকটি দফা। যেগুলো বাস্তবায়নের দাবিতে এখনও আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আন্দোলনকারীদের নামে এশিয়া এনার্জির দায়ের করা পৃথক দুইটি মামলা।
জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখার নেতা হামিদুল হক বলেন, ২৬ আগস্টের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ফুলবাড়ীতে এসে ফুলবাড়ীর বীর জনতাকে লাল স্যালুট দিয়ে ৬ দফা চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার ১৪ বছর কেটে যাচ্ছে, সেই চুক্তি আজও বাস্তবায়ন করেননি। উল্টো আন্দোলনকারী নেতাদের নামে একের পর এক মামলা করছে ওই বহুজাতিক কোম্পানি।
ফুলবাড়ী শাখা তেল গ্যাস জাতীয় কমিটি আহবায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, এশিয়া এনার্জি এখনো ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের কারণেই আন্দোলনকারীদের নামে পৃথক দুইটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা এসএম নুরুজ্জামান জামান বলেন, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েনি। ছয় দফা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় যেকোন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের অর্থ নিজেদের জ্বালানি সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এখন বিপর্যস্ত, হুমকির সম্মুখীন। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনের ভিত্তি গড়ে তোলার ওপর। আমরা যদি জ্বালানি সম্পদ দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশ উপযোগী উৎপাদন ক্ষেত্র বিকশিত করতে না পারি, তবে আমরা আমাদের মানবসম্পদও ব্যবহার করতে পারবো না। আমরা থেকে যাবো পরনির্ভরশীল দাসে, পরিণত হব পরাধীন ভিক্ষুকে। দেশ-জাতি-জনগণের সামনে এখন তাই সবচেয়ে বড় কর্তব্য হচ্ছে নিজের সম্পদ রক্ষা করা, তার ওপর নিজস্ব কর্তৃত্ব কায়েম করা।
তাই ফুলবাড়ীর কয়লাখনি রক্ষার এই আন্দোলন শুধুমাত্র ওই এলাকার নয়, সারাদেশের; এর উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। ফুলবাড়ী বাংলাদেশের সকল লড়াকু-সংগ্রামী জনগণের ঠিকানা। আসুন, ফুলবাড়ীর বীর জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন ভবিষ্যত বিনির্মাণে সংহত-ঐক্যবদ্ধ হই। গড়ে তুলি শোষণহীন-নিপীড়নহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা। সম্পাদনা – অলক কুমার