গেল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত থাকায় আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে দীর্ঘদিনের দুই শরিক বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে গভীর বিভেদ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাদের নেতারা পরস্পরকে তীব্র সমালোচনা করছেন, যা দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, অতীতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের মধ্যে যে মাত্রার বৈরিতা হয়েছে তা নজিরবিহীন। কারণ উভয় দলই তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন করার চেষ্টা করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরে আসতে না পারলে ত্রয়োদশ সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে জামায়াত অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা করতে পারে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তারা। তবে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারলে এবং নির্বাচনে অংশ নিতে পারলে বিএনপির জোটের অধীনে জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা।
বর্তমান টানাপোড়েন সত্ত্বেও বিএনপি ও জামায়াত উভয় দলের সিনিয়র নেতারা বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেছেন, তারা তাদের ঐক্য নষ্ট করতে চান না। কারণ, তারা বিশ্বাস করেন যেকোনো বিভক্তি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসাকে সহজ করতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের পর দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়, প্রধানত ইসলামী ব্যাংকের দখল এবং অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নেওয়া নিয়ে সৃষ্ট বিরোধকে ঘিরে। এরপরই জামায়াত নেতারা বিএনপির বিরুদ্ধে সারা দেশে “দখল ও চাঁদাবাজি” করার অভিযোগ করেন।
বিএনপি প্রথমে কোনো মন্তব্য না করলেও ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির সিনিয়র নেতা রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, শুধু ভারত নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধীসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এই অস্থিরতাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে নির্বাচনী কৌশল সাজাচ্ছে বিএনপিযুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে নির্বাচনী কৌশল সাজাচ্ছে বিএনপি রিজভী জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল ও টেন্ডার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। জবাবে জামায়াত এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে।
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান গত ২৩ ডিসেম্বর রংপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “দেশে পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি মাত্র দু‘টি- একটি সেনাবাহিনী, অন্যটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।” পরে রিজভী জামায়াতপ্রধানের বক্তব্যকে হাস্যকর আখ্যায়িত করেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে “ইসলামপন্থী দলের” ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জামায়াতের সমালোচনা করে বলেন, “তারা (জামায়াত) ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে একাত্তরের ভূমিকাকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে।” দল দুটির সমর্থকরা সামাজিক মাধ্যমে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে কঠোর শব্দ বিনিময় করেছে এবং তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান শত্রুতাকে ঘি ঢালছে।
বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটি স্থায়ী সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষত ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় এবং ১৯৯৯ সালে তারা আনুষ্ঠানিক জোট গঠন করেছিল। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত তারা রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে কিছু বামপন্থীসহ আরও অনেক দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করার পর থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই দুই দলের মধ্যে লক্ষণীয় মতপার্থক্য ও বিভেদ দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষ সংসদ চায় বিএনপিক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে দ্বিকক্ষ সংসদ চায় বিএনপি ২০১৮ সালে জামায়াতকে উপেক্ষা করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামসহ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে নীরবতা পালন করায় জামায়াত বিএনপির প্রতি ক্ষোভ পোষণ করে। পরে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর মতপার্থক্য মিটে গেলেও এখন আবার উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিএনপির কয়েকজন নেতার অভিযোগ, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরপরই জামায়াতের আমির প্রথম বিএনপিকে আক্রমণ করে বলেছিলেন, “একজন জালিম চলে গেলেও আরেকজনের দেশের লাগাম নেওয়া উচিত নয়।
” বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “গত সেপ্টেম্বরে বিএনপি আগাম নির্বাচনের দাবি জানালেও যাদের জনসমর্থন নেই তারা নির্বাচন চায় না।” বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ও আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে তারা সক্রিয়ভাবে সোচ্চার হলেও জামায়াত তাদের অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নির্বাচন পেছাতে চায়।তারা বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে জামায়াত এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে, যা বিএনপির অবস্থানের পরিপন্থী।যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “জামায়াত নেতাদের নেতিবাচক বক্তব্যে বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক।
”তিনি বলেন, “গত ৪৬ বছরে জামায়াত নির্বাচনী হিসেব-নিকাশে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী না হলেও মনে হচ্ছে দলটি বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।”টুকু বলেন, “জামায়াত নেতাদের তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যের ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ বিএনপি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে গণতন্ত্রপন্থী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার দিকে মনোনিবেশ করছে।”
রিজভী: ৫ আগস্টের পর ব্যাংক দখল করেছে একটি ইসলামি দলরিজভী: ৫ আগস্টের পর ব্যাংক দখল করেছে একটি ইসলামি দল
জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, “বিএনপির কিছু নেতা পুরোনো শব্দ ও অবমাননাকর বাক্য ব্যবহার করে জামায়াতের বিরুদ্ধে কটুক্তি করছেন।”আকন্দ বলেন, “জামায়াত সম্পর্কে এত পুরোনো বক্তব্য দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি। তারা যদি এসব সেকেলে বক্তব্য গ্রহণ করতেন তাহলে জামায়াতের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক সম্প্রসারণ বাড়ত না।”তিনি বলেন, “জামায়াতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় কিছু বিএনপি নেতা ঈর্ষা ও হিংসার বশবর্তী হয়ে এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন।”আকন্দ অবশ্য দাবি করেন, কিছু নেতা মৌখিক বাক্য বিনিময় করলেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে উভয় দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।জামায়াতের এই নেতা বলেন, “দুই দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য নেই। আমিও মনে করি, দুই পক্ষের সম্পর্কের অবনতি হয়নি। কিছু নেতা হতাশা ও অহংকার থেকে মন্তব্য করছেন। এটা সাময়িক অবস্থান। মূল ঐক্য অটুট রয়েছে।
”জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, “আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করে তৃণমূলের সংগঠনকে উজ্জীবিত ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে।”তিনি বলেন, “বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকে চ্যালেঞ্জ করে জামায়াতপন্থী ছাত্রশিবিরও সব শিক্ষাঙ্গনে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।”তিনি বলেন, “আমি মনে করি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন্দ্র পর্যায়ে নয়, দুই দলের তৃণমূল পর্যায়ে ফাটল ধরেছে। তবে নির্বাচনের আগে হয় দুই দল পুনরায় একত্রিত হবে, না হয় নতুন মেরুকরণ হবে।”