নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা
হারিয়ে যাওয়া নদ-নদীর মধ্যে রয়েছে- রশিয়া, হাতুরি, জলই, পুনর্ভবা, মরা গোগরা, চাড়াল বান্দ, নহনা, আমান-ধামান, কাহালাই, বাগমারা, সারডুবি, মরাটাঙ্গন ও ভক্তি নদ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ নদী শুকিয়ে গেছে এবং সেগুলো এখন ফসলের মাঠে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও ক্ষীণ স্রোতোধারা শুধুই জানান দিচ্ছে যে একসময় এখানে নদী ছিল। ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম যাকারিয়া জানান, বর্তমানে জেলায় চিহ্নিত নদীর সংখ্যা মাত্র ১৪টি।
নতুন করে পাওয়া ১৩টি নদীর তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। নতুন প্রকল্প পেলে নদীগুলো দখলমুক্ত করে পুনরায় খননের কাজ শুরু করা হবে।
স্থানীয়দের স্মৃতিতে নদী সদর উপজেলার ভেলাজান এলাকার স্কুলশিক্ষক রফিকুল ইসলাম (৬৫) ভক্তি নদের তীরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছি, এই নদীতে বড় বড় লঞ্চ চলত। জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত।
এখন শুধু স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে।’
সদর উপজেলার শুখানপুকুরী ও বালিয়া ইউনিয়নে উৎপত্তিস্থল হওয়া ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সারডুবি নদ আজ মৃতপ্রায়। পাউবোর সদর উপজেলার কার্য সহকারী শফিউজ্জামান জানান, ‘সারডুবি নদের ৭০ শতাংশ জমিতে এখন চাষাবাদ হয়, বাকি ৩০ শতাংশ ছোট ছোট খালে পরিণত হয়েছে।’ নদীপারের বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৬০) বলেন, ‘আগে এই নদীর পানি দিয়ে আমরা রান্না করতাম, কাপড় ধুতাম। এখন নদীটিই নেই, সবকিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
নদী শুকানোর প্রভাব
পীরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত কাহালাই নদ প্রায় পুরোটাই শুকিয়ে গেছে। পাউবোর পীরগঞ্জের কার্য সহকারী শারাফাত হোসেন জানান, এই নদীর ৭৫ শতাংশেই এখন চাষাবাদ হচ্ছে। কৃষক আব্দুল হামিদ (৫০) বলেন, ‘আগে এই নদীতে নৌকা চলত। মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত। এখন সেই দিন আর নেই। আমাদের জমিতে সেচ দিতেও সমস্যা হয়।’
জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নে অবস্থিত জলই নদের চিহ্নও প্রায় মুছে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা জমিলা খাতুন (৬০) বলেন, ‘আগে এই নদীর ধারে অনেক গাছপালা ছিল। ছায়া হত। এখন নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সব গাছপালাও মরে গেছে। খুব গরম লাগে।’নদী বিলীনের কারণ জেলার পরিবেশবাদী সংগঠন সৃজনের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদী শাসন, দখল ও দূষণের কারণে এসব নদী বিলীন হয়েছে। অনুসন্ধান করলে এই সংখ্যা আরো বাড়বে।’
ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নাব্যতা হারাতে হারাতে নদীগুলো সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আর এই সুযোগে দখলদারদের কবলে পড়ে মানচিত্র থেকেই বিদায় নিয়েছে অনেক নদী।’নদী উদ্ধারের চ্যালেঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়দুল ইসলাম রনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। এতে বেশির ভাগ নদীতে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ফলে নদীগুলো উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে।’
প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা জানান, কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কথা ভেবে নদীর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ১৩টি নদ-নদীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই নদীগুলো শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকারও অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। নদীগুলো পুনরুদ্ধার করা গেলে শুধু প্রকৃতিই নয়, মানুষের জীবনেও ফিরে আসবে প্রাণের স্পন্দন।