রমজান হলো রোজা, ইবাদত ও কোরআনচর্চার মাস। রমজান এমন একটি পবিত্র মাস, যখন মুসলমানরা খাদ্য ও পানীয় এবং শরিয়ত নির্ধারিত বিষয় থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করে এবং আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়।
রমজানে পাল্টে যায় মুসলিম জীবনের চিরায়ত ধারা। ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল নগরেও এই আধ্যাত্মিকতা, আল্লাহপ্রেম ও পরিবর্তিত জীবনধারা চোখে পড়ে।
রমজান মাসে তুর্কি মুসলিমরা সাধারণত উসমানীয় সাম্রাজ্যের সময় গড়ে ওঠা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মেনে চলে। তাদের কাজে পুনরুজ্জীবিত হয় হারিয়ে যাওয়া মুসলিম ঐতিহ্য।
যারা ইস্তাম্বুলে রমজান উপভোগ করার সুযোগ পায় তারা প্রায়ই গণ-ইফতারের বড় বড় আয়োজন করে, রমজানের রাতে নাগরিক জীবনের কোলাহল এবং শহরের আলোকিত মসজিদগুলো তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর বাইরে ইস্তাম্বুলের একটি লুকানো ঐতিহ্য রয়েছে, যা শুধু তারাই দেখতে পায় যারা গভীরভাবে অনুসন্ধান করে।
ধর্মীয় বিধি-বিধানের বাইরে রমজানের যে একটি সামাজিক দিকও রয়েছে ইস্তাম্বুলে গেলে আপনি তা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। বিশেষ করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের ভিড়ে জনসমাগম স্থান, পার্ক ও মসজিদের প্রাঙ্গণ পূর্ণ হয়ে যায়। শহরের কিছু বিখ্যাত স্থাপত্য যেমন—আইয়ুপ সুলতান মসজিদ, সুলাইমানিয়া মসজিদ ও ব্লু মসজিদে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। অনেকেই শহরের সরবরাহকৃত গণ-ইফতারে যোগদান করে।
এই ইফতার আয়োজনগুলো থাকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। আপনি শুধু একটি আসন খুঁজে নিন এবং চালের সঙ্গে ছোলা, মাংসের একটি অংশ, আয়রান (বেশির ভাগ খাবারের সঙ্গে পরিবেশিত সতেজ দই পানীয়) এবং রমজান পিদের (মাসজুড়ে তৈরি একটি বিশেষ রুটি) মতো একটি সাধারণ তুর্কি খাবার উপভোগ করুন। প্রায় প্রতিটি আবাসিক এলাকা ও আশপাশে গণ-ইফতারের ব্যবস্থা থাকে, যাতে স্থানীয় লোকজন ইফতারি সরবরাহ করে। গণ-ইফতার তুর্কি আতিথেয়তা ও উদারতার দারুণ প্রমাণ। এশার নামাজের সময় ঘনিয়ে আসতেই মসজিদে মুসল্লির ভিড় বাড়তে থাকে।
মানুষ দলবদ্ধভাবে তারাবির নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করে। ঐতিহাসিক মসজিদে নামাজ আদায়ের বিশেষ আগ্রহও দেখা যায়। উসমানীয় ঐতিহ্য অনুসারে প্রায় সব মসজিদেই আলোকসজ্জা করা হয়। এই আলোকসজ্জা রমজান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্পষ্ট করে। তারাবির নামাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মসজিদের পরিবেশে আধ্যাত্মিক আবহ সৃষ্টি হয়। তবে ইস্তাম্বুলের সব মসজিদে খতম তারাবি হয় না। রমজান মাসের শুরুতে সরকার যেসব মসজিদে খতম তারাবি হবে সেই তালিকা প্রকাশ করে। অন্য মসজিদগুলোয় দ্রুত তারাবির নামাজ শেষ হয়ে যায়।
তারাবি শেষ হওয়ার পরে দোকান, রেস্তোরাঁ ও ক্যাফেগুলো খাবার ও মিষ্টি সরবরাহ করে। প্রায় সারা রাত ইস্তাম্বুলের হোটেল ও ক্যাফেগুলো খোলা থাকে। ইস্তাম্বুলের কোনো এলাকায় একদল লোক ঢোল পিটিয়ে মানুষকে সাহরির জন্য ডেকে দেয়। তারা সুরে সুলে ঢোল পিটিয়ে মানুষ জাগিয়ে দেয়। এটা মূলত একটি উসমানীয় রীতি।
ইস্তাম্বুলের একটি অনন্য রমজান ঐতিহ্য মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি ও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িত। এই শহরে মাসজুড়ে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র চুল প্রদর্শন করা হয়, যা জনসাধারণের জন্য প্রিয় নবী (সা.)-এর ভালোবাসা ও বরকত লাভের একটি বিরল সুযোগ। ঐতিহাসিক এই নিদর্শন খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে বাগদাদ থেকে ইস্তাম্বুলে স্থানান্তরিত হয়। প্রথমে এটি সুলতানদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধনভাণ্ডারের অংশ ছিল। পরবর্তী সময়ে তা জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়। অধিকসংখ্যক লোককে পবিত্র চুল স্পর্শ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য নিদর্শনগুলো এক মসজিদ থেকে অন্য মসজিদে স্থানান্তরিত হয়।
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে যুক্ত আরেকটি ঐতিহ্য হলো তাঁর খিরকা বা আলখাল্লা দেখা। বিখ্যাত মুসলিম মনীষী উয়াইস আল কারনির (রহ.) বংশধররা যখন জনসাধারণের জন্য এই ধন উন্মুক্ত করেন, তখন থেকে এটি মাসজুড়ে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়।
তুরস্ক এখনো একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র। তাই দিনের বেলায় রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে খোলা থাকে। বিশেষ করে ইস্তাম্বুলে আসা অমুসলিম পর্যটকদের বিবেচনা করেই তা করা হয়। তবে যারা রমজানে ইস্তাম্বুলের প্রকৃত ও অন্তর আত্মাকে দেখতে চায় তাদের জন্য উত্তম হলো রাতের ইস্তাম্বুলকে প্রত্যক্ষ করা।