বাসার পাশের একটি মাইকে বাজছিল এক অমোঘ কণ্ঠের ভাষণ—গভীর, দৃপ্ত, দেশপ্রেমে পূর্ণ। সে ভাষণ যেন শুধু শব্দে নয়, ইতিহাসের পাতায় পাতায় প্রতিধ্বনিত হওয়ার মতোই ছিল। ভাষণটি শুনে আমার তেরো বছরের মেয়েটি হঠাৎ প্রশ্ন করল, “বাবা, এটা কি জিয়াউর রহমানের ভাষণ?” আমি যখন সম্মতি জানালাম, সে অবাক হয়ে বলল, “এত সুন্দর কথা আমি আগে কখনো শুনিনি!”
এই সরল স্বীকৃতি আমাকে গভীর ভাবনার মধ্যে ফেলে দিল। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আমার মেয়েটি, কিন্তু এটাই ছিল তার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতির কণ্ঠ শোনা। তার জানার আগ্রহ দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি বুঝলে কীভাবে এটা জিয়ার ভাষণ?” সে উত্তর দিল, “আজ তো তাঁর শাহাদাতবার্ষিকী, তাই মনে হলো!” তখনই ছয় বছরের ছেলেটিও এগিয়ে এল, জিয়া সম্পর্কে জানতে চাইল। সময়ের অভাবে মেয়েকে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে বললাম। কিছুক্ষণ পর হতাশ কণ্ঠে বলল, “বাবা, জিয়া সম্পর্কে তো কিছুই পাওয়া যায় না!”
এ দৃশ্য হয়তো শুধু আমার পরিবারের না—এটাই হলো দেশের অধিকাংশ নতুন প্রজন্মের বাস্তবতা। গত দেড় দশকে জন্ম নেওয়া শিশু-কিশোরদের অনেকেই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম জানলেও, তাঁর জীবন, সংগ্রাম বা দেশের জন্য তাঁর অবদান সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না।
ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে ইতিহাসের পৃষ্ঠার আড়ালে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এক সময় রেডিও-টিভিতে প্রচারিত হতো তাঁর অমর ঘোষণা—“আমি মেজর জিয়া বলছি…”—যা আজ আর শোনা যায় না। অথচ সেই কণ্ঠে ছিল এমন এক শক্তি, যা ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, যা আজ ভয়ে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আড়াল করে রাখা হয়েছে।
গতকাল ইউটিউবে হঠাৎ পেয়ে গেলাম একটি ডকুমেন্টারি—‘দ্য পিপলস প্রেসিডেন্ট’। সন্তানদের নিয়ে দেখতে বসে দেখি, তারা অসম্ভব মনোযোগ নিয়ে দেখছে। বারবার প্রশ্ন করছে—জিয়াউর রহমান কেবল একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, রাষ্ট্রনায়ক, জাতির দুর্দিনের পথপ্রদর্শক।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসী ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর নেতৃত্বশূন্য বাংলাদেশে তাঁর বলিষ্ঠ হস্তক্ষেপ, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, কৃষক-মজুরের উন্নয়নে খাল খনন কর্মসূচি—সবই মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছিল সন্তানেরা। তারা জানতে পারল, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করেছিলেন তিনিই; দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন; কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে এনেছিলেন যুগান্তকারী রূপান্তর।
এই মহান নেতার জীবন হঠাৎই থেমে যায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে—এক নির্মম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। কিন্তু ইতিহাসের বিকৃতি আর তথ্য লুকোনোর কৌশল আজ ধীরে ধীরে ভাঙছে। নতুন প্রজন্ম জানতে চায়, খুঁজতে চায়। তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে শহীদ জিয়ার জীবনের আদর্শ, তাঁর দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের কথা।
আমরা যারা আগের প্রজন্ম—আমাদের দায়িত্ব এই সত্য তুলে ধরা। আর তরুণদের প্রতি আহ্বান, নিজেদের ইতিহাস জানো, খোঁজ করো। কারণ, যে জাতি তার অতীত জানে না, সে জাতির ভবিষ্যৎও দুর্বিষহ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
শহীদ জিয়াউর রহমান কেবল একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র—যার আলো আজও পথ দেখাতে পারে এই প্রজন্মকে।