না যান্ত্রিক, না অযান্ত্রিক। না পৌরসভা, না বিআরটিএ। তাই সমাজের সচেতন মহল এটিকে অবৈধ, যানজট সৃষ্টিকারী আখ্যা দিয়ে থাকে। সেই অবৈধ অটোরিক্সাকে বৈধতা দিতে টাঙ্গাইল পৌরসভা চালু করছে নিজস্ব নম্বরপ্লেট সিস্টেম। আর এই সিস্টেমে জড়িতরা সিন্টিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করে টাঙ্গাইল পৌরসভায় অবৈধ অটোরিকশাকে বৈধতা দিচ্ছে। যা বাংলাদেশ পৌরসভা আইন ২০০৯ এর পরিপন্থী।
পৌরসভা কর্তৃক নির্ধারিত ফি ১০ হাজার ৫০০ টাকা নেয়ার কথা থাকলেও প্রতিটি অটোরিকশার প্লেট ৮০ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ। ফলে আগের চেয়ে আরো এক হাজার অটোরিকশার বৃদ্ধি করায় এক তৃতীয়াংশ অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে আগের যেকোন সময়ের তুলনায় যানজট বেশি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, দিন দিন টাঙ্গাইলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত অটোরিকশা বেড়ে যাওয়ায় যানজটের শহরে পরিণত হয়েছে টাঙ্গাইল পৌর এলাকা। এছাড়া ইজিবাইকের বেপরোয়া চলাচল ও চালকের অদক্ষতার কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়াও নাবালক চালকও দেখা যায় ব্যাটারিচালিত অটো চালকের আসনে। যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু নির্বিকার পৌর কর্তৃপক্ষ।
যানজটের চরম ভোগান্তি ও দুর্ভোগ থেকে শহরবাসীকে রেহাই দিতে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে ৩ হাজার অটোরিকশা দুই শিফটে ভাগ করে দেয়া হয়। এক হাজার পাঁচশ অটোরিকশা লাল রং ও অপর এক হাজার পাঁচশ অটোরিকশাকে হলুদ রঙে চিহ্নিত করে দেয়া হয়। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এক রঙের অটোরিকশা চলবে, আর দুপুর ২টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত অপর অটোরিকশাগুলো শহরের চলাচল করতে হবে।
দুই শিফট করার পরও টাঙ্গাইল শহরে অটোজট লেগেই থাকে। করোনাভাইরাসে কারণে টাঙ্গাইল শহরের মানুষের যাতায়াত কমে গেছে। তাই অটোরিকশার সংখ্যাও কম। এ সুযোগে টাঙ্গাইল পৌরসভা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজস করে আরো এক হাজার অবৈধ অটোরিকশাকে বৈধতা দেয়া সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কোন অটোরিকশা মালিক সরাসরি নম্বর প্লেট নিতে পারবে না। কাউন্সিলর বা তাদের সিন্ডিকেটের কোন সদস্যদের মাধ্যমে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা বিনিময়ে সেই নম্বরপত্র নিতে হবে। কোন অটোরিকশার মালিককে সরাসরি নম্বরপ্লেট দেয়া হয় না।
পৌরসভার একটি সূত্র জানায়, এক হাজার অটোরিকশার নম্বরপ্লেট প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। এর মধ্যে পৌরসভার কয়েকজন কাউন্সিলর ও একজন প্যানেল মেয়রও রয়েছেন। আর এই প্যানেল মেয়রের মাধ্যমেই বেশিরভাগ নম্বরপ্লেট বিতরণ করা হয়। আবার তিনি নিজেই তার সহযোগীদের দিয়ে সেগুলো বিক্রি করে যাদের নামে বরাদ্দ তাদের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
টাঙ্গাইল ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন জানান, দিন দিন শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষ এক হাজার অটোরিকশার লাইসেন্স দিয়েছে। আর সেগুলো ৮০ থেকে এক লাখ টাকায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রি করেছেন। এখন করোনার কারণে সেই রেজিস্ট্রশনের মূল ৭০ হাজারে নেমে এসেছে। আমাদেরতো এ বিষয়ে কিছুই করার নেই। আমাদের দায়িত্ব শহর যানজটমুক্ত রাখা। কিছু বলতে গেলেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
কাগমারী এলাকার সুনীল বলেন, আমি প্রতিদিন ৩০টি অটোরিকশার নম্বরপ্লেট ভাড়া দেই। প্রতি প্লেটের জন্য প্রতিদিনের ভাড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকা। আমার নিজের নামেও আছে কিছু, আর বেশ কয়েকজনের প্লেট নিয়ে এসে ভাড়া দিয়ে থাকি। বর্তমানে পৌরসভার প্লেট পাওয়া খুব দুর্লভ বিষয়। পুরাতন প্লেট এক লাখ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাঙ্গাইল পৌরসভার এক কর্মচারী বলেন, সরাসরি প্লেটের জন্য গেলে পৌর কর্তৃপক্ষ প্লেট দেবে না। পৌরসভার কাউন্সিলর বা পৌর কর্তৃপক্ষের কোন কর্মকর্তার মাধ্যমে প্লেট নিতে হবে। তা না হলে বছরের পর বছর ঘুরেও প্লেট পাওয়া যাবে না। কাউন্সিলররা তাদের ভাগের প্রতি প্লেট এক লাখ থেকে শুরু করে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে।
‘৩৫৪৫’ নম্বর প্লেটের মালিক মিলন জানান, তার কাছে বেশ কয়েকটি নতুন ও পুরাতন লাইসেন্স রয়েছে। সেগুলো তিনি ভাড়া এবং বিক্রি করেন। তবে নতুনের চেয়ে (তিন হাজারের উপরে) পুরাতন লাইসেন্সের চাহিদা বেশি। কারণ পুরাতন লাইসেন্স (এক থেকে তিন হাজারের মধ্যে সিরিয়াল) বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে এক লাখের মধ্যে। কারণ এগুলো ডিজিটাল প্লেট। আর নতুনগুলোর দাম প্রতিটি ৬০ থেকে ৭০ হাজারের মধ্যে। কারণ এগুলো এখনো ডিজিটাল প্লেট হয়নি।
তিনি বলেন, পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের যোগসাজসে অতিরিক্ত এক হাজার লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এগুলোর কোন বৈধতা নেই। শুধু স্টিকার দিয়েই চলছে এসব অবৈধ ব্যটারিচালিত অটোরিকশা।
‘৩৬০১’ নম্বর প্লেটের মালিক আলামিন নামের অটোরিকশা চালক জানান, তিনি গত ছয় মাস আগে এক লাখ টাকা দিয়ে ওই নম্বর প্লেটটি কিনেছেন। তবে তাকে এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নম্বর প্লেট দেয়া হয়নি।
‘৩২৭৭’ সিরায়ালের নম্বর প্লেটটিও আরোক চালক মোসলেম উদ্দিন প্রতিদিন ৬০ টাকা করে ভাড়া দিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন।
‘৩৮৯৫’ সিরিয়ালের মালিক সোনা মিয়া জানান, তিনি ৯৫ হাজার টাকায় এটি একজন কাউন্সিলরের মাধ্যমে কিনেছেন। এখন তিনি এটি প্রতিদিন ৬০ টাকা করে ভাড়া দিচ্ছেন। তার কাছে আরো দুইটি রয়েছে। সেগুলোও মাসিক হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে।
টাঙ্গাইল পৌরসভার সহকারি কর আদায়কারী রনজিত চন্দ্র পাল জানান, প্রতিটি অটোরিকশার লাইসেন্স নতুন নিবন্ধন করতে হলে সরকারি ফি ১০ হাজার ৫০০ টাকা এবং নবায়ন করতে ভ্যাটসহ এক হাজার ৭২৫ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে শহরে কতগুলো অটোরিকশা রয়েছে এবং নতুন নিবন্ধনের জন্য সরকারি ফি’র অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন কিনা- এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান মিরন বলেন, নম্বরপ্লেটে টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে কিনা বিষয়টি আমার জানা নেই। আমরা প্রশাসনের সাথে মিটিং করে চাহিদা অনুযায়ী অটোরিকশার বৈধতা দিয়ে থাকি। যা প্রয়োজন তার বেশি আমরা লাইসেন্স দেই না। যদি সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকে যে নম্বর প্লেটে টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে, তবে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেবো।