আগামী ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ভারতের বিহার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। ২০২৬-এ রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইনসভার ভোটও। ঠিক এই সময়ে ভারতের জাতীয় ও প্রাদেশিক রাজনীতিতে আলোচনায় ‘এসআইআর’। ওতপ্রোতভাবে চর্চায় রয়েছে ‘বাংলাদেশি’-ও। যদি ৯৫ বছর বয়সী কেউ ‘এসআইআর টেনশন’ রোগে আক্রান্ত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তখন এটি নিছক নির্বাচন পূর্ববর্তী একটি পরিসংখ্যান হিসেবে থাকে না। এটি রূপ নেয় জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়কেন্দ্রিক আলোচনাতেও। তবে সেটি কীভাবে? উত্তর হলো, অনেকভাবেই হতে পারে।
আসলে কী এই ‘এসআইআর’, এর লক্ষ্যই বা কী? মূলত, এসআইআর বা ‘স্পেশাল ইনটেন্সিভ রিভিশন’ এর লক্ষ্য হলো ভোটার তালিকা থেকে যাতে কোনো যোগ্য নাগরিক বাদ না পড়ে, এটি নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি, অযোগ্য কেউ যাতে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয়, সে বিষয়টিও দেখা হয়। এতে পুরনো ভোটার তালিকার ওপর নির্ভর না করে একেবারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য হালনাগাদ করে নতুন তালিকা তৈরি করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন স্টাইলে দেশটির নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) আন্তর্জাতিক সীমানার প্রতি জ্ঞান বাড়াতে বলেছেন। এর পেছনে অবশ্য কারণ রয়েছে।
আসলে ভারতের মানচিত্র দেখলে ব্যাপারটায় যে কেউ পরিস্কার ধারণা পাবে। ভারতে রোহিঙ্গা ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা আছে— এমন একটি বিষয়কে মুখ্য ধরে পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর করা হবে যখন বলা হলো, তখন দেখা যায় রাজ্যটির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত নেই। যদি মিয়ানমার থেকে ভারতে রোহিঙ্গা প্রবেশ করেই থাকে, তাহলে প্রথমে সেটি মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড অথবা অরুণাচল প্রদেশ হয়েই ভারতে ঢুকবে। তারপর না হয় তারা অন্য রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে ইসি এই চার রাজ্যে এসআইআর রাখেনি।
যদি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ হয়ে বাইপাস করে ভারতে প্রবেশ করে সেক্ষেত্রে উপরের চার রাজ্যের প্রয়োজন হবে না। তবে সেটি এত সহজও নয়। কারণ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে। তাদের নিজস্ব শক্তিশালী নৌযান নেই, যেটি ব্যবহার করে তারা পশ্চিমবঙ্গের দিঘা সমুদ্র সৈকতে নোঙর করে ভারতে প্রবেশ করবে।
বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর গলায় অবশ্য এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ইতিবাচক গান শোনা গেছে। তার বিশ্বাস, এসআইআর অবশ্যই হবে এবং তাতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করা হবে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে জিতে এসে বিজেপি সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
রোহিঙ্গার পর যে শব্দটি এই ইস্যুর সবচেয়ে আলোচিত তা হলো, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’। এটি বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতিতে ‘সিরিয়াস থেকে ফানি’ একেবারে সার্বিক ভ্রমণ সম্পন্ন করেছে। কারণ একেবারে এলিট আলোচনা থেকে বর্ডারে ধরা পড়া, দুটোতেই এই ইস্যু চলে আসে।
তবে আসামে কিন্তু এসআইআর নিয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এই রাজ্য ছাড়া মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামও বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তবর্তী। একজন বাংলাদেশিকে কলকাতা বা আগরতলার চেয়ে আইজলে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।
আবার, গত বছর বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারের পতন হয়। এরপর থেকেই শেখ হাসিনা অবস্থান করছেন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ‘দিল্লিকে বাংলাদেশিমুক্ত করব’ বলার পর অনেক নেটিজেনই এই বিষয় নিয়ে মক করেছেন। বলেছেন, দিল্লিতে তো শেখ হাসিনা আছে, উনিও বাংলাদেশি। আম আদমি পার্টির এই নেতা অবশ্য এর উত্তরে কিছু বললে আমরা জানতে পারতাম। সম্ভবত চুপই ছিলেন।
এদিকে, খোদ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যেবার বিহারে নির্বাচনী এক জনসভায় ‘এই রাজ্যে প্রচুর বাংলাদেশি আছে’ বলে বক্তৃতা দিলেন, তখন আসাদউদ্দিন ওআইসি বলেছিলেন, ‘এখানে কোনো বাংলাদেশি নেই, দিল্লিতে আপনার এক বোন রয়েছে’।
এর বাইরে রয়েছে আরেক ঘটনা। ঢাকা ও কলকাতার প্রথম সারির বেশকিছু গণমাধ্যমই বলেছে কলকাতার নিউটাউনসহ বেশকিছু এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছেন। অনেকেকে প্রকাশ্যে দেখা-ও গেছে।
অপরদিকে, ভারতে রয়েছে ‘সিএএ’, যার অধীনে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈনসহ সেই দেশের সংখ্যালঘুরা দেশটিতে নিরাপদ আশ্রয় চাইলে ভারত সেটি দেয়। ২০১৯ সালে এই আইন পাশ করে দেশটির কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট। আদতে এই সিএএ-তে বেশিরভাগ অনুরোধই আসে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে। এখন ভারতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের একজন হিন্দু কর্মী যদি সেখানে স্থায়ী অবস্থান করতে চায়, সেক্ষেত্রে বিজেপি সাদরে গ্রহণ করবে, তৃণমূল ‘বেশি কথা বলবে না’।
লেখার দ্বিতীয় প্যারায় যে আত্মহননের কথা উল্লেখ করা, সেটি ৯৫ বছর বয়সী এক হিন্দু বৃদ্ধ ক্ষিতিশবাবুর ঘটনা। তার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তিনি সেখানে বাস করছেন। তবে তার আদি নিবাস বাংলাদেশের বরিশালে। ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেনি ভারতের ইসি। এবার হয়ত তার মনে শঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল, ‘যদি এবার ইসি আমাকে অবৈধ নাগরিক ঘোষণা করে!’ একজন চার দশক ধরে ভারতে বাস করা হিন্দু বৃদ্ধ যখন সিএএ সিস্টেম থাকার পরও আত্মহনন করে, তখন বিষয়টা রাজনীতিবিদদের বিস্তরভাবে ভাবার উপলক্ষ এনে দেয়।
দেশটিতে এনআরসি ও সিএএ নিয়ে দেশজুড়ে যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল, এবার সেই নকশাই ধীরে ধীরে জাতীয় থেকে প্রাদেশিক ভোট ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। আসলে ‘এনআরসি’ ও ‘সিএএ’র একটি দুর্দান্ত যৌথ সিক্যুয়েল হলো এই ‘এসআইআর’।
মূলত, এসআইআর নিয়ে যে আতঙ্ক, তার অনেকটা দায়ী নাগরিকত্ব হারানোর দুর্ভাবনা। ভোটার হিসেবে স্বীকৃতি হারালে দেশছাড়া হতে হবে— এমন ভাবনায় শঙ্কা ও ভয়ের রেশ তো আছেই। এই গল্পে দিল্লি থেকে কলকাতা কিংবা বিহার, ‘বাংলাদেশি’-ও যেন রয়েছে সমান আলোচনায়।











