নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী এক দশককে দেশের চলচ্চিত্রের অন্ধকার যুগ বলা হয়। অশ্লীলতা চলচ্চিত্রের ক্যানসারে পরিণত হয়। সে সময় দেখেছি, যারা অশ্লীল সিনেমা নির্মাণ করতেন, তারা একটি আলাদা সম্প্রদায় হয়ে থাকতেন।
অশ্লীল সিনেমা বানিয়ে এর সংবাদ যাতে পত্র-পত্রিকায় না আসে, এজন্য অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন। অর্থাৎ তিনি সিনেমা বানিয়েছেন, এটা সংবাদ হোক, তা চাইতেন না। কেবল সিনেমা হলের মালিকরা জানলেই হলো। হল মালিকরাও গোপনে এসে সিনেমাটি নিয়ে গোপনে গোপন দর্শকদের জন্য চালিয়ে দিতেন। যাকে বলে সিনেমার গোপন ব্যবসা। আমরা এর বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি করেছি। প্রখ্যাত নির্মাতাদের বক্তব্য নিয়ে ধারাবাহিকভাবে রিপোর্ট করেছি। তথ্য মন্ত্রণালয় কিছু কিছু অ্যাকশনও নিয়েছিল।
রিপোর্ট করতে গিয়ে কখনো দেখিনি বিশিষ্ট এবং ভালো নির্মাতারা অশ্লীল সিনেমার নির্মাতা ও প্রযোজকের পক্ষাবলম্বন করেছেন। যাই হোক, সেসব অশ্লীল সিনেমায় যারা অভিনয় করত, দুয়েকজন বাদে তাদের বেশির ভাগই দর্শকপ্রিয় বা অতি পরিচিত ছিল না। বিশেষ করে যেসব কাটপিস সিনেমায় জুড়ে দেয়া হতো, সেগুলোর পারফর্মাররা ছিল একেবারে অচেনা। শ্রেণীভূক্ত পার্ভার্টেড দর্শক শুধু তাদের যৌন দৃশ্য উপভোগ করত। ব্যস, এ পর্যন্তই। আমাদের সাংবাদিকদেরও অনেকে তাদের চিনত না। তবে অশ্লীল দৃশ্যের এসব পারফর্মার পারফর্ম করতে করতেই একশ্রেণীর দর্শকের কাছে পরিচিতি পেয়েছে।
অশ্লীল সিনেমা শেষ, তারাও শেষ। এত কথা বলার অর্থ হলো, সম্প্রতি যেসব অশ্লীল ওয়েব সিরিজ নিয়ে বিতর্ক চলছে, সেগুলোর নির্মাতারা বেশ পরিচিত এবং যারা অশ্লীল সিনেমাকে হার মানানো দৃশ্যে পারফর্ম করেছেন, তারা কিন্তু দর্শক পরিচিতি আগে পেয়েছেন, তারপর অশ্লীল দৃশ্যে পারফর্ম করেছেন। তাদের সুনাম রয়েছে। তারা অশ্লীলতা দিয়ে পরিচিতি পাননি। ফলে তারা যখন অশ্লীল দৃশ্য বা সরাসরি টু এক্স দৃশ্যে পারফর্ম করেন, তখন দর্শকের আগ্রহ-উৎসাহ প্রবল থেকে প্রবল হওয়া স্বাভাবিক এবং একই সঙ্গে খারাপ ধারণা পোষণ করাও স্বাভাবিক। তারা এমন নয় যে, শুধু এক্স রেটেড সিনেমার পারফর্মার, সিনেমা দেখা শেষে তাদের ভুলে যাবে।
যেমনটি ঘটেছে অশ্লীল সিনেমার পারফর্মারদের ক্ষেত্রে। যাই হোক, অতি পরিচিত এসব নির্মাতা এবং পারফর্মার অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ করেছেন এবং তাদের এ কাজ কোনো ধরনের যুক্তি দিয়ে জায়েজ করার সুযোগ নেই। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এ নিয়ে পুরো মিডিয়া যখন সোচ্চার, তখন কোনো কোনো নির্মাতা অশ্লীল ওয়েব সিরিজের পক্ষ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় তাদের যুক্তি দিয়ে প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছেন। তাদের যুক্তির মধ্যে রয়েছে, অশ্লীল ওয়েব সিরিজ পাইরেসি হয়েছে। তাদের ভাষায় ওয়েব সিরিজের শুধু বিশেষ দৃশ্য (অশ্লীল) পাইরেসি করে ছেড়ে দিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তারা এ যুক্তি দিয়ে যে প্রকারন্তরে অশ্লীলতার বিষয়টি স্বীকার করে নিলেন, তাতে সন্দেহ নেই।
আরেকটি যুক্তি দিয়ে বলেছেন, এসব সিরিজ সাবস্ক্রাইব করে দেখার কথা, তা না করে পাইরেসির মাধ্যমে উন্মুক্তভাবে দেখা হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, তাদের কথামতো সাবস্ক্রাইব করা জায়গায় দর্শকপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের টু এক্স বা থ্রি এক্স সিরিজ দেখা যেতে পারে এবং এসব জায়গায় তাদের পারফর্ম করা দোষের কিছু না। তাদের আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, দর্শক টিভিতে যা দেখেন তা ওয়েব সিরিজে দেখতে চান না। তারা বলতে চাচ্ছেন, দর্শক ওয়েব সিরিজে পরিচিত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের টু এক্স কিংবা থ্রি এক্স দেখতে চান। বেকুব কাহাকে বলে! যেখানে ইন্টারনেটে বাহারি রকমের লাখ লাখ টু অ্যান্ড ট্রিপল এক্স সিরিজ দেখা যায়, সেখানে কি এই যুক্তি খাটে? অবশ্য তারা যদি মনে করেন, দেশি জিনিসের প্রতি মানুষের প্রবল চাহিদা রয়েছে, তাহলে আলাদা কথা। তারা বয়সভিত্তিক দর্শক বিবেচনা করে অনুষ্ঠান নির্মাণ, মানে এ ধরনের সিরিজ নির্মানের যুক্তি দিয়েছেন, তা নাহলে বিশ্ব থেকে আমরা নাকি পিছিয়ে পড়ব। তাদের কথা অনুযায়ী, অশ্লীলতাকে ধারণ করে আমাদেরকে বিশ্বায়নের দিকে যেতে হবে। কী বিশিষ্ট, অবশিষ্ট যুক্তি রে বাবা! তাদের এসব যুক্তি দেখে এটুকু কারো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, তারা অশ্লীলতাকে সমর্থন করেছেন এবং তাদেরকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্তরা তাদের পক্ষ হয়ে ওকালতিতে নিযুক্ত করেছেন। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়, যেখানে চলচ্চিত্রের অশ্লীলতার যুগে বিশিষ্টজনরা কখনোই অশ্লীলতা এবং এতে পারফর্মকারিদের হয়ে বিবৃতি দেয়া দূরে থাক, প্রতিনিয়ত ঘৃণা প্রকাশ করেছেন, সেখানে ড্রয়িং রুম বা পারিবারিক মিডিয়ার অশ্লীলতার পক্ষে কতিপয় বিশিষ্টজন দাঁড়িয়ে গেছেন!! এটাকে তাদের পার্ভার্শন ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? এহেন পরিস্থিতি দেখে মন পুরে যায় নাকি পুড়ে যায়, বোঝা বড়ই মুশকিল হয়ে পড়েছে।