২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট, দিনটি ছিল ছাত্র-জনতার এক ঐতিহাসিক বিজয়ের দিন। সেদিন স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দাবিতে সারাদেশের ন্যায় রাজধানী ঢাকার বাড্ডা এলাকায় ঘেরাও কর্মসূচি ছিল ছাত্র-জনতার। সেই কর্মসূচিতে সকাল ৯ টায় অংশ নেন সিএনজি চালক সুজন। শুধু সুজনই নয়, তার মতো হাজারো ছাত্র-জনতা নানা বাঁধা পেরিয়ে কর্মসূচিস্থলে একের পর এক জড়ো হতে থাকে। সকাল ১০ টার দিকে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়।
এতে তার পাশে এক ছাত্র আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। এ সময় সিএনজি সুজন এলোপাথারি ছররা গুলিকে অপেক্ষা করে নিজের জীবন বাজি রেখে সেই ছাত্রকে উদ্ধারে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যায় এবং পুলিশের ছররা গুলি সুজনের পুরো শরীরে লাগে। গুলি লাগার পর কিছ্ক্ষুণের মধ্যেই সে অসচেতন হয়ে পাশ^বর্তী একটি দেয়ালের পাশে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত পড়ে থাকে। সেময় বাড্ডার রাজপথে পুলিশের গোলাগুলি চলমান থাকায় তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরে বিকাল ৪ টার দিকে ৩টি বাসার ৩টি দেয়াল ভেঙে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকার আফতাব নগর নাগরিক হাসপাতালে নেন আন্দোলনকারীরা। এরপর ওই হাসপাতালে আহত সুজন চিকিৎসা না পেলে পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ নেওয়া হয়, কিন্তু সেখানেও অতিরিক্ত হতাহতদের চিকিৎসার কারণে ভর্তি করা হয়নি।
তারপর সেখান তাকে নিয়ে আসা হয় তার গ্রামের বাড়ি। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারিভাবে তাকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করলেও পরিবারের উপার্জনসক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় অর্থাভাবে পথে বসতে হয় তাকে। অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে জীবিকানির্বাহ করলেও তার খোঁজ-খবর কেউ নেননি বলে জানায় সুজন। এখন সে খেয়ে-না খেয়ে পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করছে। আহত সিএনজি চালক সুজনের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার অলোয়া ইউনিয়নের আকালু গ্রামে। বাবা মৃত আনছের আলী। তিনি বাবার ৩ সন্তানের মধ্যে একমাত্র বড় ছেলে ও পেশায় সিএনজি চালক। প্রাইমারিতে পড়াশোনা করা অবস্থায় প্রায় ৩০ বছর আগে তার বাবাকে হারায় সে। তারপর থেকেই কঠিন এক দুর্বিসহ জীবন পরিচালনা করতে হয় তাকে। পরিবারের হাল ধরতে প্রাইমারির পড়াশোনা বন্ধ করে রিকশা চালানোর উদ্দেশে পারি জমায় রাজধানী ঢাকায়। সুজন ঢাকায় রিকশা চালনার পাশাপাশি স্থানীয় জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল।
এছাড়া তিনি উপজেলার অলোয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে তিনি বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিএনপির বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নিতো। সম্প্রতি সে রিকশা চালনা ছেড়ে দিয়ে ঢাকার বাড্ডা এলাকায় ভাড়ায় সিএনজি চালাতো এবং একদিন সিএনজি না চালালে যার চুলো জ¦লবে না তা জেনেও সে শেখ হাসিনা সরকার পতনে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার বাড্ডা থানা ঘেড়াও কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করে। গুলিতে আহত হওয়ার পর পরিবার নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে। সুজন বলেন- আমার মৃত বাবাও একজন প্রতিবাদী লোক ছিল। আমি দরিদ্র লোক হলেও অন্যায় অত্যাচার অবিচার সহ্য করতে পারি না। ৫ আগস্টের আগেও আমি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করেছি । জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে অন্যদিনের মতো ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে বাড্ডা থানা ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করি। সকাল ১০ টার দিকে পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু করে। পুলিশ আমাদের উপর একতরফা গুলি বর্ষণ করে।
এক পর্যায়ে পুলিশের ছররা গুলির ২’শ ৯৬টি স্পিন্টার আমার শরীরে লাগে। আমি অচেতন অবস্থায় দেয়ালের পাশে পড়ে থাকি। তারপর পরের দিন সকালে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার জ্ঞান ফিরে। আমার শরীরে এখনো প্রায় ৩’শ গুলির স্পিøন্টার রয়েছে। আমি চলাফেরা করতে পারি না। ক্রাচের মাধ্যমে হাঁটলেও ব্যাথা বেড়ে যায় ও শরীর ফুলে শক্ত হয়। খেয়ে না খেয়ে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করে আসছি। কেউ খোঁজ নেয় না। এমন অবস্থায় আমার উন্নত চিকিৎসা ও আর্থিক সহযোগিতা দরকার। আমার বিকাশ নম্বর ০১৯২১-৬৯৪০৯১ এবং সোনালী ব্যাংক ভূঞাপুর শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর- ৬০০৩৮০১০২২৩৫৩, দু’টি মাধ্যমে আমাকে আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ কররছি। সুজনের স্ত্রী নূপুর বলেন- আমি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, আমার বাবাও নেই। আমার স্বামী আহত হওয়ার দিন ৫ আগস্ট আমার সংসারে একটি টাকা ও কোনো খাদ্য সামগ্রী ছিল না। খবর পেয়ে আমার বাবার বাড়ি বরিশালের বিভিন্ন জনের সহযোগিতায় ৮০০ টাকা সংগ্রহ করে স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য ঢাকায় যাই। ওর আহত হওয়ার পর থেকে সংসারে কোনো আয় নেই। বর্তমানে আমার শ্বশুড় বাড়ি এলাকার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে হাত পেতে চেয়ে চিন্তে খেয়ে না খেয়ে জীবন পাড় করছি।
এমনো দিন যাচ্ছে চুলায় আগুন জ¦লে না। এমন অবস্থায় আমার ৩ সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নূপুর আরও বলেন- আমার স্বামীসহ প্যারালাইসড, শ^াশুড়ির খাবার ও ঔষধও যোগাড় করতে পারছি না। সম্পদ বলতে বাড়ির মাত্র ৩ শতাংশ জায়গা। সেখানে জরাজীর্ণ ১৬ হাতের একটি কাঁচা ঘরে শ^াশুড়ি, আমরা স্বামী-স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে খুব করুণ অবস্থায় থাকি। মেরামতের অভাবে ঘরটিও যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। গত কয়েক মাস আগে উপজেলা থেকে আমরা কিছু সাহায্য পেয়েছিলাম যা আমাদের বেশ উপকার হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আামাদের অবস্থা ভয়াবহ। আহত স্বামী চিকিৎসার খরচ ও সন্তানদের লেখা করাতে পারছি না। বেঁচে থাকার জন্য সকলের সাহায্য কামনা করছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোছা: পপি খাতুন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এ উপজেলায় একজন নিহত ও তালিকামতে ১৬ জন আহত রয়েছে।
এর বাহিরেও আহত থাকতে পারে। নিহত ও আহতদের পরিবারকে সরকারি ও ব্যক্তিভাবে সহযোগিতা প্রদান করে আসছি। আহতদের মধ্যে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, সরকারিভাবে এখনো আহতের কর্মসংস্থানের কোনো নির্দেশ আসেনি। তবে, আহত পরিবারগুলো যাতে কোনো সমস্যায় না পড়ে সে ব্যাপারে প্রশাসন ও সমাজসেবা কাজ করছে।
১। ৩’শ গুলির স্পিøন্টার শরীরে বহন করে দূর্বিসহ জীবন যাপন করছে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের সুজন।
২। অজ্ঞান অবস্থায় দেয়ালের পাশে পরে ছিল ৬ঘন্টা, জ্ঞান ফিরে ১২ঘন্টা পর।
৩। অর্থাভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না তার ও তার প্যারালাইসড মায়ের।
৪। বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছেলে মেয়ের লেখা পড়া।
৫। নিয়মিত চুলো জ¦লে না সুজনের পরিবারে।