২০২৪ সালে ফরাসি উপকূল থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে রেকর্ড ১৪ শিশু মারা গেছে বলে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে এসব তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট। আর এই তথ্যকে ‘জাগরণের ডাক’ বলছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা।
মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্ট ২০২৪ সালে ইংলিশ চ্যানেলে প্রাণ হারানো ও নিখোঁজ অভিবাসীদের তথ্য সংগ্রহ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, গত বছর রেকর্ড ৮২ জন অভিবাসী মারা গেছে, যাদের মধ্যে অন্তত ১৪ শিশু রয়েছে। এর আগে এই পথে এত শিশু মৃত্যুর তথ্য নথিবদ্ধ হয়নি। মিসিং মাইগ্রেন্টস প্রজেক্টের কর্মকর্তারা মনে করেন, তাদের সংগ্রহ করা তথ্য মৃত বা নিখোঁজ অভিবাসীর সঠিক সংখ্যাকে প্রতিনিধিত্ব করে না। প্রকৃত সংখ্যাটি আরো বেশি বলেই ধারণা করছেন তারা। গত বছর ইংলিশ চ্যানেলে অভিবাসী মৃত্যুর সংখ্যা তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে রেকর্ড করা ২৪ জনের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ২০২৩ সালে প্রাণ হারানো ২৪ অভিবাসীর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ছিল এক। এর আগে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চ্যানেলে প্রাণ হারানো শিশুর সংখ্যা ছিল এক থেকে পাঁচের মধ্যে। কিন্তু গত বছরে মারা গেছে ১৪ জন শিশু।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত চ্যানেলে পাঁচ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, তবে তাদের মধ্যে কোনো শিশু নেই বলে জানা গেছে। গত বছরের শেষে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অভিবাসীদের মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা এবং নিখোঁজদের তথ্য সংগ্রহের কাজটিকে আরো উন্নত করা।
আইওএম কর্মকর্তারা
উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, শিশুরা এই কঠিন যাত্রা থেকে বেঁচে গেলেও, তারা মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে এবং পুনর্মিলনের সুযোগ অনেক কম। গত বছর মারা যাওয়া ১৪ শিশুর মধ্যে কারো কারো নাম পরিচয় জানা যায়নি।
যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে রয়েছে ১৪ বছরের ওবাদা আবদ রাব্বো ও ১৬ বছরের মোহামেদ আল জাবাউই। তাদের দুই জনই গত বছরের ১৬ জানুয়ারি একই দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ইরাক থেকে যাওয়া সাত বছর বয়সী রোলা আল মায়ালি তার পরিবারের সঙ্গে নৌকায় ছিল, সেটি চ্যানেলে ডুবে গেলে তার মৃত্যু হয়। যুক্তরাজ্যে পৌঁছনোর আশায় তারা নৌকায় উঠেছিল। ২৩ এপ্রিল মারা গেছে ইরাক থেকে যাওয়া সাত বছর বয়সী সারা আল আশিমি। ইরাকি কুর্দিস্তান থেকে যাওয়া এক মাস বয়সী মারিয়াম বাহেজ মারা যায় ১৭ অক্টোবর। অতিরিক্ত যাত্রীবাহী নৌকায় বাবার হাত থেকে পড়ে গেলে মৃত্যু হয় তার।
যুক্তরাজ্যে আইওএমের
মিশনপ্রধান ক্রিস্টা রোটেনস্টাইনার বলেন, ‘গত বছর ইংলিশ চ্যানেলে রেকর্ডসংখ্যক শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা আমাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। এটি দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের আরো উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যাদের পরিচয় জানা গেছে, সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাবেন তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বা অত্যন্ত অস্থির অবস্থা থেকে এসেছে। আরো নিরাপদ ও নিয়মিত রুট জরুরিভাবে প্রয়োজন। এ ছাড়া পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুদের জন্য সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
সেইফ প্যাসেজ ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী ড. ওয়ান্ডা ওয়াইপোরস্কা বলেন, ‘ছোট ও অতিরিক্ত যাত্রীবাহী নৌকায় চ্যানেল পার হওয়া একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। কোনো শিশুরই এমন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়া উচিত নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যে তরুণদের জন্য কাজ করি, তারা আমাদের সঙ্গে হৃদয়বিদারক সব ঘটনার কথা বলেছেন। তারা ভেবেছিলেন, তারা মারা যাবেন। ভাঙা ইঞ্জিনের পেট্রলে পোড়ার যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে তাদের, সাঁতার না জানার কারণে পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত ছিলেন তারা।’
ওয়াইপোরস্কা বলেন, ‘আমরা জানি, এসব যাত্রার অভিজ্ঞতায় শিশুরা গভীরভাবে মানসিক আঘাত পায় এবং এই নৌকাগুলোতে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলতেও তাদের অনেক সময় লাগতে পারে। অনিরাপদ যাত্রায় এত শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ভয়াবহ। এর অর্থ হলো, শিশুদের জীবন বাঁচাতে পারে—এমন নিরাপদ পথ না থাকার কারণেই এসব ঘটছে।’