বিশেষ প্রতিবেদক : রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার নগর বাথান গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান কামাল হোসেন ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশে উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে যোগদান করেন। প্রথম কর্মস্থল শেরপুর জেলা। পুলিশের এসআই হিসেবে পিএসআই পিরিয়ড অতিক্রম না করেই তার চেয়ে বেশী বয়সের এক বিধবা মহিলাকে দুই সন্তানসহ বিয়ে করেন কামাল হোসেন। সেই বিধবা মহিলার মৃত স্বামী ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট অফিসার আবুল কাশেম। বর্তমানে এই দম্পতি শত কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন থানায় চাকরি করে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৫ সালে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগদান করেন গাজীপুর জেলার টঙ্গী পূর্ব থানায়। এ সময় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। মন্ত্রীর সাথে সুসম্পর্ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নানাভাবে চাঁদাবাজি ও অনিময়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
গাজীপুরের এমসি গার্মেন্টস, মায়ের দোয়া রিয়েল এস্টেটের মালিক গাজীপুরের শিল্পপতি মো. কামরুজ্জামানসহ অনেক ব্যবসায়ীদের সাথে তার রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। যেগুলো পরিচালনা করেন তার স্ত্রী উম্মে রোমান। ওসি কামাল তার ছোট ভাই ময়নুল ইসলামের নামেও অসংখ্য ব্যবসা করে যাচ্ছেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত টঙ্গী থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০২১ সালে ওসি হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহের ভালুকা থানায়। তারপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে বদলী করা হয় পার্শ্ববর্তী ত্রিশাল থানায়। সে সময় তার বিরুদ্ধে নৌকার পক্ষে প্রচারণার অভিযোগ উঠে এবং নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করা হয়। এ ব্যাপারে অভিযোগের পরও কামাল হোসেনকে ত্রিশাল থানা থেকে অদৃশ্য কারণে বদলি করা হয়নি।
ছাত্র-জনতার অভ‚্যত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওসি কামাল হোসেনের অবৈধভাবে উপার্জিত শত কোটির টাকার সম্পদের তথ্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। রাজবাড়ীর সন্তান কামাল হোসেনের নিজ জেলা ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, শেরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বিলাশবহুল বাড়ী, জমি, রিসোর্ট, মাছের খামার, সঞ্চয়পত্র ও একাধিক গাড়ি। স্ত্রী, কন্যা, ভাই, মা-বাবা ছাড়াও নামে-বেনামে গড়েছেন এসব শতকোটি টাকার সম্পদ।
অনুসন্ধানে যা জানা যায় –
জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় নিজের পছন্দমত থানায় বদলী নিয়ে যতদিন ইচ্ছা ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রয়োজনে কাউকে সরিয়ে দিয়ে চেয়ার দখল করতেন। মূলত গাজীপুরের টঙ্গী পূর্ব থানা, ময়মনহিংহের ভালুকা ও ত্রিশাল থানায় চাকরি করেই তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হন। বর্তমানে ওসি কামাল হোসেনের স্ত্রী উম্মে রোমানের নামে রাজধানী ঢাকার উত্তরার ৯ নং সেক্টরে রয়েছে বিলাশবহুল একটি ৮ তলা বাড়ী। বিভিন্ন দেশ থেকে অধিকাংশ সরঞ্জামাদি ক্রয় করে এনে বাড়িটি সাজানো হয়েছে। এছাড়াও ঢাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট।
কামাল হোসেনের নিজ জেলা রাজবাড়ীর নগর বাথানে ‘ঝিলিক মঞ্জিল’ নামে রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির বিলাশবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ী। গাজীপুরের হোতাপাড়া ও মনিপুরে উম্মে রোমানের নামে রয়েছে কয়েক একর জমি। তার শ্বশুর বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদীতে স্ত্রীর নামে, শেরপুর পৌরসভা সংলগ্ন গোপালবাড়িতে স্ত্রী, দুই সৎ মেয়ে কুমি ও কনকচাঁপার নামে এবং রাজবাড়ীতে ভাই ময়নুল ইসলাম ও মা-বাবার নামে কিনেছেন কয়েক কোটি টাকার জমি। বেনামে গাজীপুরে একটি রিসোর্টও পরিচালনা করছেন বলে জানা গেছে। ওসি কামাল হোসেন অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা সাদা করতে স্ত্রীর নামে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায় ৬ একর জায়গায় একটি মাছের খামার গড়ে তুলেন। তবে মাছ চাষ না হলেও আয়কর ফাইল ভারী করার জন্য ওই খামারটিকে কাগজে-কলমে ব্যবহার করেছেন।
অনুসন্ধানে আরো যা উঠে আসে –
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওসি কামাল হোসেনের পরিবার একাধিক গাড়ি ব্যবহার করলেও গাড়িগুলোর নিবন্ধন একাধিক ব্যক্তির নামে। তার ছোট মেয়ে ঝিলিক চলাচল করেন প্রায় কোটি টাকা মূল্যের কালো রঙের একটি হ্যারিয়ার গাড়িতে, যার রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ ১৭-৫৭৬৬। স্ত্রী উম্মে রোমান চলাচল করেন এক্স করোলা ও টয়োটা ফিল্ডার গাড়িতে। টয়োটা ফিল্ডার গাড়িটির রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ঢাকা মেট্রো গ ২৮-৭২০৫। ওসি কামাল হোসেন তার সৎ মেয়ে কনকচাঁপার নামে শেরপুর জেলার প্রধান ডাকঘরে ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ৩০ লাখ টাকার এফডিআর কিনেন।
এছাড়াও শেরপুরের আইএফআইসি ব্যাংকে ৩০ লাখ টাকার এফডিআর কিনেন। ওই ব্যাংকে টাকার উৎসের জায়গায় ওসি কামাল হোসেন তার শ্বাশুড়ির নামে কেনা ৩৫ লাখ টাকার একটি সঞ্চয়পত্রের কাগজ দাখিল করেন। ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি তারিখে তার শ্বাশুড়ির নামে কেনা সঞ্চয়পত্রের নম্বর গসপ-চ-০২৬৮৫১১-৫১৭ (সাতটি সঞ্চয়পত্র, যার প্রতিটির মূল্য ৫ লাখ টাকা)। একজন ওসির স্ত্রী হয়ে উম্মে রোমান বছরে কয়েকবার সিঙ্গাপুর যান ঘুরতে ও চিকিৎসা করাতে। সিঙ্গাপুরের মালাবার থেকে কিনেছেন শত ভরির উপর স্বর্ণালংকার। মেয়েরাও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন, বর্তমানে তার মেয়ে কুমি বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর সারাদেশের পুলিশ সদস্যরা যখন নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ, ঠিক সে সময়েও কামাল হোসেনের ফেসবুক ওয়ালে সাবেক যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সাথে একটি হাস্যোজ্জল ছবি ছিলো। নানা অপকর্মে অভিযুক্ত পুলিশের এই কর্মকর্তা (বিপি ৭৭৯৯০৩৮৭৮৭) বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার বঙ্গবন্ধু সেতু (পূর্ব) নৌ ফাঁড়িতে কর্মরত রয়েছেন।
অভিযুক্ত কামাল ও এসপির বক্তব্য –
বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব নৌ ফাঁড়ির আইসি ওসি কামাল বলেন, আমার নিকটাত্মীয় আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো করে বেড়াচ্ছে। আমার কোন এই ধরনের অভিযোগ নাই আমি সব সময় সত্যের পথে চলার চেষ্টা করি।
টাঙ্গাইল নৌ পুলিশের এসপি সোহেল রানা বলেন, যদি তার বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ করে বা আমরা পাই তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী যে ব্যবস্থা গ্রহন করা যায় উর্ধতন কৃতপক্ষ সেই ব্যবস্থা গ্রহন করবে।