১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে মওলানা ভাসানীর জন্ম। তার পিতা হাজী শারাফত আলী ও বেগম শারাফত আলীর পরিবারে চারটি সন্তাানের জন্ম হয়। একটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে। মো. আব্দুল হামিদ খান সবার ছোট। তার ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোট থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মৃত্যুবরণ করেন। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত ও দুই ছেলে মারা যায়। বেঁচে থাকেন ছোট শিশু আব্দুল হামিদ খান।
সিরাজগঞ্জে জন্ম হলেও মওলানা ভাসানী তার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলের সন্তোষে। তিনি তার কৈশোর-যৌবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শোষণ ও বঞ্চনাহীন এবং প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আজীবন সংগ্রাম করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে মওলানা ভাসানীর অবদান অবিস্মরণীয়।
পিতৃহীন আব্দুল হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। আব্দুল হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেছের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদ- ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ি জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নামের সাথে ‘ভাসানী’ যুক্ত হয়।
১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭-এ মওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগের কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মীসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মী সম্মেলনে যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে ওই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক এবং যৌথভাবে যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও খন্দকার মোশতাক।
এরপর ১৯৫৭ সালের ৯-১০ ফেব্রুয়ারি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আয়োজন করেছিলেন ‘কাগমারী সম্মেলন’। সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তায় তোরণ নির্মিত হয়। সেই তোরণগুলির নামকরণ করা হয় বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং ব্রিটিশ বিরোধী উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে।
এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়কের। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্নো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। জহরলাল নেহেরু, বিধান চন্দ্র রায় ও জামাল আবদুল নাসের চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করেন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তার ভাষণের এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তার সুপরিচিত ও সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন।
আজীবন সংগ্রামী মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দী হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদা-ই-খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইল শহরের সন্তোষে পীর শাহজামান দীঘির পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
আফ্রো-এশিয়া লাতিন আমেরিকার অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৩তম ওফাতবার্ষিকী ১৭ নভেম্বর। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
বিংশশতকে ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিক ও গণআন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন মওলানা ভাসানী। জীবদ্দশায় তিনি ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে সমধিক পরিচিত, অনেকে তাকে ‘লাল মওলানা’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন।