মব জাস্টিস বা জনতার বিচার কি? প্রয়োগ সমাজের জন্য কতটা প্রয়োজন?
ফেরদৌস খান বিদ্যুৎ : মব জাষ্টিস আসলে কি? আইনগত ভাবে কখন এই শব্দের প্রচলন : মব জাস্টিস শব্দটি ইংরেজি থেকে এসেছে, যেখানে “মব” বলতে উত্তেজিত জনতা বা উত্তেজিত জনসমাগমকে বোঝানো হয় এবং “জাস্টিস” বলতে বিচার প্রক্রিয়াকে বোঝায়।
তাই, মব জাস্টিস বলতে বোঝায় জনতা কর্তৃক বিচার বা শাস্তি প্রদান, যেখানে তারা আইন বা প্রাতিষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে নিজেরাই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়।
আরো পড়ুন – ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার উপর গুলি করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা
আমাদের ভিতর এক বৃদ্ধ মুল ধারনা আছে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এই মব জাষ্টিস হয়ে থাকে।
কিন্তু এই উপমহাদেশে অহরহ মব জাষ্টিস হয়ে থাকে চোর ডাকাত বা ধর্ষক এর ক্ষেত্রে।
সাধারণত জনতা এ ধরনের বিচার করতে গিয়ে সহিংস হয়ে ওঠে এবং প্রায়শই গনপিটুনিতে হত্যা করে ফেলে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ২০১৯ সালে ২১ শে জুলাই একজন নারীসহ তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা।
মব জাস্টিসের উৎপত্তি ও ইতিহাস :
মব জাস্টিস বা লিঞ্চিংয়ের প্রথা মূলত প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন সমাজেই পাওয়া যায়, কিন্তু আধুনিক ইতিহাসে এর প্রসার ঘটে মূলত যুক্তরাষ্ট্রে ১৮শ এবং ১৯শ শতকে।
আমেরিকায় মূলত দাস প্রথার যুগে এবং দাস প্রথার পরবর্তী সময়ে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের সদস্যরা কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত সহিংসতা চালাত।
“লিঞ্চ ল’” (lynch law) শব্দটি তখন থেকেই প্রচলিত হয়। ফ্রিডরিখ নিৎসের বলেছিলেন “Injustice, one must confront one’s enemies face to face”.
প্রকৃত ন্যায়বিচারের জন্য সাহস এবং প্রত্যক্ষ মোকাবিলার প্রয়োজন।
শত্রু বা অপরাধীকে সরাসরি মুখোমুখি হয়ে বিচার করা ছাড়া ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, বিশেষত যখন আমরা দেখি মব জাস্টিস বা জনতার হাতে বিচার সমাজে ব্যাপক অস্থিতিশীল তৈরি করছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মব জাস্টিসের ক্ষতি: মব জাস্টিস বা জনতার বিচার আমাদের দেশে ক্রমশ একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
যখন জনতা আইন ও আদালতের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং নিজেদের হাতে শাস্তি প্রয়োগ করতে শুরু করে, তখন সমাজে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।
আরো পড়ুন – স্বৈরাচার বিদায় হয়েছে। প্রেতাত্মারা এখনো ঘোরাফেরা করছে
নিৎসের উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মব জাস্টিস কোনোভাবেই ন্যায়বিচার নয়, কারণ এখানে সরাসরি মোকাবিলা নয়, বরং ক্রোধ, হিংসা, এবং গণপিটুনির মাধ্যমে অবিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এর ফলে ন্যায়বিচারের মূল ভিত্তি—প্রকৃত বিচার, প্রমাণ ও শাস্তির যৌক্তিকতা—লঙ্ঘিত হয়।
উদাহরণ –
ডয়েচে ভেলে একটা রিপোর্ট করেছিলো ১৯/০৩/২৪ র বিগত চার বছরে গণপিটুনিতে হত্যা হয়েছে ২২৪ জন৷ ৫ আগষ্ট ফেসিষ্ট পতনের পর অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে তার কোনো ডাটা এখনো বের হয়নি৷
তবে চোখের সামনেই ঘটছে অনেক ঘটনা, কাউকে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরেও ফেলা হচ্ছে; কাউকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে; আবার কাউকে জুতোর মালা পরিয়ে কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে৷
ফলাফল –
এভাবে মব জাস্টিস চলতে থাকলে মানুষ বিচারব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা হারাতে থাকবে।
তারা ভাবতে শুরু করবে এ বিচার ই ভাল।
দেশে বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বা আইনপ্রয়োগকারীরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না।
এর ফলে সমাজে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়বে। সহিংসতা বৃদ্ধি পাবে। মানুষকে হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিবে।
এর থেকে কেও নিস্তার পাবেনা। মব জাস্টিসের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়।
অনেক সময় অপরাধী না হয়েও কোনো ব্যক্তি জনতার ক্রোধের শিকার হন, অপরাধ না করেও শাস্তি পান।
এর ফলে নিরীহ মানুষও শিকার হয় বিচারহীনতার এবং প্রকৃত অপরাধীরা বহাল তবিয়তে থেকে যায়।
আরো পড়ুন – যে কোন মূল্যে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে এ ঐক্য ধরে রাখতে হবে
মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে সংবেদনশীলতা হারাতে থাকে এবং সহিংসতাকে একধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আসে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মব জাস্টিসের বিপরীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি।
নিৎসের উক্তি অনুসারে, ন্যায়বিচার মানে হলো অপরাধী বা শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি এবং সঠিকভাবে মোকাবিলা করা।
এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থা এবং আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে বিচার হওয়া প্রয়োজন, যেখানে অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি হবে এবং নিরপরাধ হলে রক্ষা পাবে।
ন্যায়বিচার কেবল শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়, এটি একটি সমাজকে স্থিতিশীল এবং সুশৃঙ্খল রাখার জন্য অপরিহার্য।
বিচার ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা থাকলে তারা নিজের হাতে বিচার করবেনা।
এর ফলে সমাজে শান্তি বজায় থাকবে এবং সহিংসতার পরিবর্তে মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা ও মানবিকতা গড়ে উঠবে।
আন্তর্জাতিক পর্যায় –
অন্যদিকে মব জাষ্টিস এর কারনে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটি অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত পায়।
যার দরুন এই মব লিঞ্চিংয়ের কারনে এ শত্রু রাষ্ট্রের জন্য সুযোগের সৃষ্টি করে।
তারা এ ধরনের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনতে পারে।
একই সঙ্গে, বাংলাদেশের ভেতরে বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা অসন্তুষ্ট শ্রেণীগুলোকে উস্কে দিতে পারে, যা অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা আরও বাড়াবে।
তাছাড়া, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে শত্রু রাষ্ট্র বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
সামাজিক বিভাজন এ দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরিতে ভুমিকা রাখতে পারে।
মব জাস্টিস কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি একটি নৈতিক বিপর্যয়। প্রকৃত ন্যায়বিচার কেবল আইনের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।
বাংলাদেশে মব জাস্টিসের এই ভয়াবহ প্রভাব ঠেকাতে হলে আমাদের বিচারব্যবস্থাকে আরও কার্যকর, স্বচ্ছ, এবং দ্রুত করতে হবে, যাতে মানুষ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি আস্থা রাখে এবং ন্যায়বিচারে ভরসা পায়।
সমাজে যখন আইনের শাসনের পরিবর্তে “মব জাস্টিস” বা জনতার বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সমাজের স্থিতিশীলতা এবং নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়ে।
আরো পড়ুন – ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে সন্তানের মৃত্যু দেখে পরিবার
মব লিঞ্চিং, যা মূলত জনতার হাতে বিচারের নামে সহিংসতার এক নির্দিষ্ট ধরণ, একটি গভীরভাবে সমস্যাজনক এবং অমানবিক প্রবণতা।
এটি সামষ্টিকভাবে সমাজের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানোর প্রতিফলন, যা দেশকে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়।
উপসংহার :
মব লিঞ্চিং বা মব জাস্টিস কোনো সমাজের পক্ষে একধরনের স্থায়ী বিপদ ডেকে আনে।
এটি ফ্যাসিবাদী সহানুভূতি বাড়িয়ে দেয় এবং দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করে।
শত্রু রাষ্ট্রগুলো এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়ানোর জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
এ ধরনের পরিস্থিতি রোধে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।