ডেস্ক নিউজ : এবার ঈদের ছুটির সময় সড়কে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় ৪৮ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী।
এসব দুর্ঘটনার কারণ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মোটরসাইকেলচালক ছিলেন বেপরোয়া।
একটি মোটরসাইকেলে চালকের বাইরে সর্বোচ্চ একজন আরোহী তোলার নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।
চালক ও আরোহীদের বেশির ভাগেরই হেলমেট ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে বৈধ লাইসেন্সও ছিল না চালকের।
কয়েক বছর ধরেই ঈদের ছুটিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও মৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। প্রতিবারের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে মোটরসাইকেল।
প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ এপ্রিল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার (৫ মে) পর্যন্ত সাত দিনে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই (৩১ জন) মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী।
বিশেষজ্ঞদের মতামত –
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর-তরুণদের অনেকে নিয়ম না মেনে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালায়, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে।
এ ছাড়া মহাসড়কে ধীর গতির যানবাহন চলাচল বন্ধ না হওয়া, চালকদের বিরতিহীনভাবে একটানা যানবাহন চালানো, ফাঁকা সড়কে বেপরোয়া গতি—ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
ঘটনা পর্যালোচনা –
ঈদের পরদিন বুধবার পঞ্চগড় সদর উপজেলায় মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পথে দুর্ঘটনায় মারা গেছে তিন কিশোর।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলার তালমা-মডেলহাট সড়কে কিশোরদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ হয়।
এরপর তিন কিশোর যে মোটরসাইকেলে ছিল সেটি সড়ক থেকে ছিটকে গিয়ে পাশের একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়।
গুরুতর আহত অবস্থায় তিন কিশোরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। দুর্ঘটনায় অন্য মোটরসাইকেলে থাকা দুই তরুণও আহত হন।
আর ঈদের দিন মঙ্গলবার টাঙ্গাইলে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া তিন বন্ধুর দুজন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
জেলার ধনবাড়ী উপজেলার কুইচামারা সেতুর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে তাদের মোটরসাইকেলটির।
ধনবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইয়ার হোসেন বলেন, মোটরসাইকেলটি বেপরোয়া গতিতে চলছিল।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য –
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ঈদুল ফিতরের ছুটির আগে-পরের দুই সপ্তাহে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত হন।
নিহতের ৪৩ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। নিহতদের বড় অংশই ছিল কিশোর-তরুণ। কয়েক বছর ধরে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দুর্ঘটনাও বাড়ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে।
এতে মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ।
২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ এবং এই দুর্ঘটনাগুলোতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫১ শতাংশ বেড়ে যায়; এবার ঈদুল ফিতরে অনেকেই মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরেন।
গত বুধবার রাত ১২টা থেকে শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টায় ২১ হাজার ৩৬০টি মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপার হয়।
১৯৯৮ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর তিন দিনের হিসাবে এত বিপুলসংখ্যক মোটরসাইকেল এর আগে কখনো পারাপার হয়নি; স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় উঠে এসেছে, মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে অধিকাংশ চালক নিয়ম মানেন না।
এক মোটরসাইকেলে দুজনের বেশি না ওঠার নিয়মটিও মানা হয় না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলও অহরহ চলে; অনেকেরই মোটরসাইকেল চালানোর কোনো প্রশিক্ষণ থাকে না।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বেপরোয়া গতির পাশাপাশি মহাসড়কে কীভাবে চলতে হয় কিশোর-তরুণদের অনেকেই তা ভালোভাবে জানে না।
আর আন্তঃজেলা বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করতে হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরেও মহাসড়কে স্বল্পগতির যান চলাচল বন্ধ হয়নি।
সড়ক পরিবহন আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না।
তথ্য ও ছবি – প্রথম আলো; সম্পাদনা – অলক কুমার