ইচ্ছে ছিল কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় বছরের শেষ সূর্যাস্ত উপভোগ করার। কিন্তু নানা কারণে বগা লেক পৌঁছাতে বেশ দেরি হয়ে গেল। সূর্য অস্ত গেলে পথ চলতে অসুবিধা হবে ভেবে বেশ দ্রুত পা চালাতে শুরু করলাম। সূর্য যখন অস্ত যাবে যাবে করছে, পাহাড়ের আড়ালে নিজেকে নিমজ্জিত করছে, তখন দার্জিলিংপাড়া থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সন্ধ্যা যেহেতু হয়েই গেছে, সেহেতু বেশ সময় নিয়ে পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়া লাল টকটকে সূর্যের অস্ত যাওয়া উপভোগ করেছিলাম পাহাড়ের পিঠে বসে, গাছে হেলান দিয়ে।
দূরে সবুজ পাহাড়ের আড়ালে টকটকে লাল সূর্য ছোট থেকে বড় আকার ধারণ করছিল। সবুজ পাহাড়ের গাছে গাছে টুকরো মেঘের ওড়াউড়ি, দূরের কোনো পাহাড়ি পাড়ায় আগুনের উত্তাপ ছড়ানো ধোঁয়া ওঠার সংকেত, স্বচ্ছ আকাশে সন্ধ্যাতারার উপস্থিতি, মধ্য আকাশে খণ্ড চাঁদের হাসি। ধীরে ধীরে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে যাচ্ছে একটু একটু করে। বেশ লাগছিল দেখতে। সবুজ পাহাড়ের সাদা মেঘ, কালো গাছ আর ধূসর ধোঁয়ার খেলা, পাহাড়ের চূড়ায় সূর্যের বসে থাকা, খণ্ড চাঁদের বাঁকা হাসি, সন্ধ্যাতারার লুকোচুরি, গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে।
পাহাড়ের সূর্যাস্ত বেশিক্ষণ উপভোগ করা হলো না। দেরি হয়ে যাচ্ছে, রাতের অন্ধকার নামবে একটু পরেই, পৌঁছাতে হবে কেওক্রাডংয়ে। আবারও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করতে বাধ্য হলাম। বেশ দ্রুত পা চালাতে বাধ্য হলাম শেষ ডিসেম্বরের পাহাড়ি শীতের আক্রমণ থেকে বাঁচতে। যদিও কেওক্রাডং পৌঁছাতে আরো প্রায় দুই ঘণ্টা লেগেছিল। ভীষণ ঠাণ্ডার কারণে চূড়ায় উঠেও বেশিক্ষণ থাকা হয়নি, সবাই যার যার মতো খেয়ে ঘুমাতে চলে যাওয়ার জন্য।
অনেক রাতে একবার ঘুম ভেঙে গেল, বাইরে শোঁ শোঁ শব্দের তোড়ে ঘুম ভেঙে গেল। বেশ কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাইরে ভীষণ ঝড় উঠেছে ভেবে। কারণ, পাহাড়ের চূড়ায় টিনের ঘরটা তখন রীতিমতো কাঁপছে, নড়ছে আর মাঝেমধ্যে দোলা দিয়ে যাচ্ছে! যেন বাইরে সাইক্লোন উঠেছে! কিন্তু শেষ ডিসেম্বরের এই শীতে তো এমন ঝড় ওঠার কথা নয়, তাহলে?
খুব কষ্টে, কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে লেপের তলা থেকে মুখ বের করতেই হাঁ হয়ে গেলাম ঘরের ভেতরের রূপ দেখে। কারণ, এত রাতে অন্ধকারের পরিবর্তে ঘরভর্তি পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত। টিন ও বাঁশের বেড়ার যেখানে যতটুকু ফাঁকা পেয়েছে, চাঁদের আলো তার সবটুকু ভেদ করে অন্ধকার ঘরে একটা অপার্থিব আলো-আঁধারি, একটা মায়াময় জগৎ তৈরি করে রেখেছে। এমন অসম্ভব সুখের রাত এ জীবনে তখনো আর আসেনি। পুরো ঘরে জোছনার অন্য রকম এক সুখের খেলা চলছিল। এমন অপার্থিব রাতের রূপ দেখতে একটু বাইরে বের হতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কিছুটা ভয় আর শঙ্কা থাকায় সঙ্গে সঙ্গে বের হতে পারিনি।
তবে এমন জোছনা আর তার রূপের আকর্ষণে বেশিক্ষণ বিছানায়ও থাকতে পারিনি। ঝোড়ো বাতাসের ভয় উপেক্ষা করেই যা যা গরম কাপড় ছিল, সব পরে বাইরে বের হলাম। ভাগ্যিস বেরিয়েছিলাম, নইলে অনন্তকাল এমন পাহাড়ের চূড়ায় প্রথমবারের মতো সাদা সমুদ্র দেখা থেকে বঞ্চিত থেকে যেতাম। বাইরে বেরিয়ে একটু পাহাড়ের কিনারায় যেতেই ভয়-শঙ্কা সব নিমেষেই উধাও হয়ে গেল পাহাড়ের মাঝে এক বিশাল সাদা ধোঁয়া ওঠা নদী দেখে। এখানে যে এত বড় কোনো নদী আছে পাহাড়ের খাঁজে, সেটা তো জানতাম না!
অনেকক্ষণ বসে বসে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বয়ে যাওয়া ধোঁয়া ওঠা নদীতে রুপালি চাঁদের আলোর বিচ্ছুরণ দেখছিলাম, দেখছিলাম পাহাড়ের গাছের ফাঁকে ফাঁকে জোনাকির জ্বেলে যাওয়া নীল আলোর রোশনাই, আকাশে লক্ষ তারার মিটমিট করে জ্বলে থাকা, স্বচ্ছ আকাশের কোথাও কোথাও মেঘের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা, আবার কোথাও মেঘের দলবেঁধে ছুটে যাওয়া। একসময় শীত, বাতাস, একাকী থাকাটা আর বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে দিলো না। তাই বাধ্য হয়েই উঠে পড়লাম। বিছানায় গিয়ে আর ঘুম আসে না কখন সকাল হবে সেই প্রতীক্ষায়।
কোনো ভাবেই আগামী সকালের সোনালি রোদ, ঘাসে জমে থাকা শিশিরবিন্দু, পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে থাকা সাদা মেঘ, কুয়াশার আলিঙ্গন, প্রথম সূর্যের উষ্ণ পরশ কিছুতেই মিস করতে চাই না। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঠিক মোরগ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল। পর্যাপ্ত গরম কাপড় পরে বেরিয়ে পড়লাম। কেওক্রাডংয়ের ওপরে প্রথম সূর্যোদয় দেখার জন্য।
আহ, কী ছিল সেই সকালটা, কোথায় তাকাব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না…।
পুবাকাশে আলো ফোটার অপেক্ষায় পাহাড়ের অধীর আগ্রহ, পাহাড়-মেঘের জড়াজড়ি, কুয়াশার মাখামাখি, আকাশে কত যে রঙের খেলা, যত দূর চোখ যায় শুধু পাহাড়ের উঁচু-নিচু প্রান্তর। একপাশে পাহাড়ের ঝোপঝাড়, পাখিদের কিচিরমিচির, পাহাড়ি মোরগের ডেকে যাওয়া, অন্য পাশে মেঘের সমুদ্র। রাতে সেটাকে নদী ভেবেছিলাম, সকালে জানলাম ওটা আসলে নদী নয়, দুপাশের পাহাড়রাজির মাঝে অনেক বড় একটা ফাঁকা জায়গা থাকায় বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাজুড়ে মেঘ জমে নদীর মতো লাগে। শুধু আমি নই, অনেকেই নাকি ওই মেঘের জমে থাকাকে নদী বলে ভুল করে।
চারদিকের পাহাড়ে মেঘ আর কুয়াশার অবিচ্ছেদ্য আলিঙ্গন। পাহাড়ের চূড়ায় সবুজ ঘাসে জমে থাকা শিশিরের কণা। কোথাও লজ্জাবতীর লাজুক হাসি, শিশির ঝরে পড়তেই শরমে ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকানো। এসব দেখতে দেখতে সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করল আকাশজুড়ে। ধূসর আকাশজুড়ে তখন রং-বেরঙের খেলা। সূর্যের আলো পড়ায় পুরো কেওক্রাডংয়ে যেন এক সোনালি সকালের আবির্ভাব হলো।
চারদিকে সোনা ছড়ানো রোদের হাসি, গাছের পাতায় সোনালি রোদের ঝিলিক, ঘাসের শিশিরে সোনালি রোদের আভা। চারদিকে যেন সোনায় মোড়ানো একটা সকাল। যেদিকেই তাকাই সব জায়গায় যেন সোনা ছড়ানো রোদ্দুরের আহ্বান, আকর্ষণ আর আরাম। গোলাপি গোধূলি, রুপালি রাত আর সোনালি সকালের অপার্থিবতা।
সূত্র: ntvbd.com/travel