নিজস্ব প্রতিবেদক : টাঙ্গাইলে বৃদ্ধ বাবাকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতনের পর জমি লিখে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে মেয়ে, জামাতা আর নাতি ও নাতনির বিরুদ্ধে।
জেলার বাসাইল উপজেলায় সম্প্রতি ঘটনাটি ঘটেছে।
লোমহর্ষক ওই বর্বরতার আতঙ্কে নির্যাতনের প্রায় এক বছর পর মারা গেলেন বৃদ্ধ বাবা হযরত আলী (১০৬)।
আর মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগে সাংবাদিকদের ইশারায় মেয়ে ও জামাতার নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন শতবর্ষী বৃদ্ধ হযরত আলী।
হযরত আলী বাসাইল উপজেলা ফুলকি ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের মরহুম কাজিমুদ্দিনের ছেলে।
আরো পড়ুন – টান টান উত্তেজনার মধ্যে টাঙ্গাইলে মহান মে দিবস পালিত
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) সন্ধ্যায় নিজ বাসস্থানে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
বুধবার (১ মে) সকাল ১০টায় জানাজার নামাজ শেষে বালিয়া উত্তরপাড়া সামাজিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
মেয়ে, জামাতা ও নাতি, নাতনির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেছেন বৃদ্ধের ছেলে, মেয়েসহ প্রতিবেশিরা।
জীবিত অবস্থায় পুলিশ, সাংবাদিক ও স্থানীয়দের তার উপর চলা নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন বৃদ্ধ হযরত আলী।
অন্যদিকে, ফুলকি মৌজার দক্ষিণপাড়াস্থ লিখে নেয়া ৮৩ শতাংশ জমির দলিল পন্ডের মামলাও করেন তিনি।
অভিযুক্ত ছোট মেয়ে ফরিদা ও জামাতা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট নুরুল ইসলাম, তাদের ছেলে মেহেদী হাসান ও মেয়ে সোহেবা আক্তার কনা তৃতীয় মেয়ে মরহুমা মমতা বেগম ও আব্দুস ছালামের সন্তান।
ফরিদা ও জামাতা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট নুরুল ইসলাম বাসাইল পৌর শহরের বসবাস করলেও মেহেদী কামুটিয়া গ্রামে আর কনা টাঙ্গাইল পৌর শহরের পূর্ব আদালত পাড়ায় বসবাস করেন।
ঘটনার বর্ণনা –
জানা যায়, ২০২৩ সালের ৭ মে হযরত আলীর মালিকাধীন ৫৩ শতাংশ জমি বাসাইল সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে ১৪৯৩ নং হেবা দলিল মূলে লিখে নেন ছোট মেয়ে ফরিদা বেগম, ১৪৯৪ দলিল মূলে ১২ শতাংশ নাতি মেহেদী হাসান আর ১৫০২ নং দলিল মূলে ১৮ শতাংশ নাতনি সোহেবা আক্তার কনা।
পরবর্তীতে হযরত আলী চলতি বছরের ২১ মার্চ টাঙ্গাইল সদর থানার সিনিয়র সহ-জজ আদালতে ছোট মেয়ে ফরিদা বেগমের ১৪৯৩ নং দলিলে লিখে নেয়া ৫৩ শতাংশ জমির দলিল পন্ডের জন্য ১৪১ নং মোকদ্দমাসহ ২৪ মার্চ বাসাইল থানাসহ জজ আদালতে নাতি মেহেদী হাসানের ১৪৯৪ নং দলিল এর ১২ শতাংশ জমির দলিল পন্ডের জন্য ৫৩ নং আর নাতনি সোহেবা আক্তার কনার ১৫০২ নং দলিল এর ১৮ শতাংশ জমির দলিল পন্ডের জন্য ৫৪ নং মোকদ্দমা করেন।
ভূক্তভোগী, তার সরিক ও প্রতিবেশীদের বক্তব্য –
মরহুম হযরত আলীর ছেলে নওজেশ আলী বলেন, দুই বোন মৃত্যুবরণ করলেও আমিসহ আরও দুই বোন জীবিত আছেন।
ফরিদা আমার ছোট বোন। বাবার বয়স হওয়ার কারণে নিজ বাসস্থানে কম থাকতেন।
বোনদের বাড়িসহ একেক এক সময় দীর্ঘদিনের জন্য বেড়াতে বের হতেন।
বেশ কিছুদিন বাবা ওই বাড়িতে থাকায় আমার মেজ বোন ও আমার ছেলেরা বাবাকে আনতে ফরিদার বাড়িতে যান।
ফরিদার অসৎ উদ্দেশ্য থাকায় সে সময় বাবাকে তারা আসতে দেয়নি।
আরো পড়ুন – সংঘর্ষ এড়াতে ট্রাক রেখে রাস্তা বন্ধ করে দিলো পুলিশ
পরবর্তীতে বাড়িতে রাখার সুযোগে বাবাকে হাত পা বেধে মারধর করাসহ আটক রেখে আর নির্যাতন চালিয়ে ৮৩ শতাংশ জমি লিখে নিয়েছে।
জমি লিখে নেয়ার পরে গুরুতর অসুস্থ বাবাকে তারা বাড়িতে পৌঁছে না দিয়ে আমার চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে রেখে যায়।
বাবার মুখে তার উপর চালানো নির্যাতনের কথা আমরা শুনি।
তিনি জানান, পরবর্তীতে ফরিদা, তার স্বামী নুরুল ইসলাম, আমার বড় বোনের ছেলে মেহেদী ও মেয়ে কনা হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালানোসহ জোড় করে জমি লিখে নেয়ার কথা জীবিত অবস্থায় বাবা বাসাইল থানার ওসি, সাংবাদিকসহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের জানিয়েছেন।
এছাড়াও তিনি নিজে বাদি লিখে নেয়া ৮৩ জমির দলিল পন্ডের মোকদ্দমাও করেন। বাবা মোকদ্দমা করার পর থেকে ফরিদা মামলাসহ নানা ভাবে আমাদের হয়রানী করছে।
ওই নির্যাতনে কারণে আর আতঙ্কে আমার বাবা মারা গেছেন। আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিব।
চাচাতো ভাই নিজামুদ্দিন বলেন, একদিন ফরিদা ফোন দিয়ে আমাকে জানায় আমার চাচা ও তার বাবা অসুস্থ, আপনি এসে নিয়ে যান।
এ কথার কারণে আমি তাকে বলি তুমি তোমার বাবাকে বাড়িতে পৌছে দাও, আমি কেন নিয়ে আসবো।
এরপর ফরিদা ও কনা এসে নিজ বাড়িতে না দিয়ে চাচাকে আমার বাড়িতে রেখে চলে যায়।
এ সময় চাচা আমাদের জানায় ফরিদারা আমার হাত-পা বেঁধে ও মারধর করে জমি লিখে নিয়েছে।
পরবর্তীতে চাচা জমির দলিল পন্ডের মোকদ্দমা করাসহ নির্যাতনের কথা থানার ওসি, সাংবাদিক ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিদের জানায়।
অভিযুক্ত ফরিদার স্বামীর কথা –
অভিযুক্ত ফরিদার স্বামী নুরুল ইসলাম বলেন, আমার শ্বশুর মারা গেলেন সে খবরটিও আমাদের জানানো হয়নি।
আমি আমার স্ত্রী ফরিদা শ্বশুরকে মারধর করে জমি লিখে নিয়েছি অভিযোগটি মিথ্যা।
অভিযোগকারী নওজেশ ও বউ ছেলেরা মিলে আমার শ্বশুর ও শাশুড়িকে অত্যাচর করে জমিজমা লিখে নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তারা অত্যাচার করতো বলেই আমার শশুর আড়াই বছর আমার বাড়িতে ছিলেন।
তিনি বাড়িতে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ায় আমার স্ত্রী ফরিদা ও ফরিদার বোনের মেয়ে কনা আমার শ্বশুরকে নিয়ে চাচাতো শুমুন্দি নিজামুদ্দিনের বাড়িতে গিয়েছিল।
ওসির কাছে দেয়া শ্বশুরের অভিযোগ সাজানো বলে দাবি করেন তিনি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ও পুলিশের বক্তব্য –
ফুলকি ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং ওয়ার্ড সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, হযরত আলীর জমি হাত-পা বেঁধে মেয়ে ও জামাতার লিখে নেয়ার বিষয়টি জানিনা।
তবে তার মেয়ের জামাতার একটি লিখিত অভিযোগ ছিল, তার স্ত্রীকে বাড়িতে ও শ্বশুরকে দেখতে বাঁধা দেয়ার।
চেয়ারম্যানের কথায় আমি মেয়ে ফরিদাকে নিয়ে হযরত আলীর বাড়িতে গিয়েছিলাম।
আরো পড়ুন – সরকারি নির্দেশনা অমান্য করার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে সৃষ্টি
বাসাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল আমীন বলেন, বেশ কিছুদিন আগে হযরত আলী থানায় এসে আমার কাছে তার মেয়ে ফরিদা কর্তৃক নির্যাতনের বিষয়টি আমাকে মৌখিকভাবে অবগত করেছিলেন।
সে সময় তিনি জোর করে জমি লিখে নেওয়ার বিষয়টি আমাকে জানালেও তখন তিনি কোন লিখিত অভিযোগ করেননি।
পরবর্তীতে জমিজমার ঝামেলা নিয়ে উনার মেয়ে ও জামাতাও থানায় অভিযোগ দেন।
মঙ্গলবার রাতে ওই বৃদ্ধ মারা গেছেন বলে শুনেছি।
ভূক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানান তিনি।