নিজস্ব প্রতিবেদক : বয়োজ্যেষ্ঠ জয়গন বেগম। বয়স প্রায় ৭০ ছুঁইছুই।
২০১৪ সালের ৮ আগস্টে তার মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে ভোটার তথ্য হালনাগাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে মৃত দেখানো হয়।
অথচ প্রায় ৯ বছর ধরে জীবিত রয়েছেন জয়গন বেগম।
কাগজে-কলমে এই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটিকে মৃত দেখানোর পরেও পরিবারের সঙ্গে কাজকর্ম করছেন। সবার সাথে মিশছেন।
এছাড়া তাকে মৃত দেখানোর কারণে কয়েক বছর ধরে বিধবা ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
এমন ভুলের জন্য তথ্য হালনাগাদকারী দায়ি করছেন স্বজনরা।
বয়োজ্যেষ্ঠ জয়গনের নাতনী রোমা আক্তার বলেন- ‘আমার দাদীর নামে একটি বিধবা ভাতা কার্ড ছিল।
এক বছর আগে সেই বিধবা কার্ডের ভাতা উঠাতে গেলে উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে জানানো হয় দাদী মারা গেছেন কয়েক বছর আগে।
তারপর নির্বাচন অফিসে গেলে সেখানে ভোটার আইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) নম্বর সার্চ দেয়া হয়।
আমার জীবিত দাদীকে সেখানেও মৃত দেখায়। এতে করে দাদীর ভাতা বন্ধ রয়েছে’।
আরো ভূক্তভোগীদের কথা –
জীবিত থাকা মৃত জয়গন বেগমের বাড়ী টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের কামারকুমুল্লী গ্রামে।
তিনি মৃত ইউসুফ আলীর স্ত্রী।
জয়গনের কোনো সন্তান না থাকায় ও স্বামী মারা যাওয়ার পর বাড়ির ভিটে-মাটি বিক্রি করে কয়েক বছর যাবত তার ভাইয়ের বাড়ি বড়কুমুল্লী গ্রামে বসবাস করছেন।
মৃত জয়গনের খোঁজ নিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় তিনি বেঁচে আছেন। তার স্বামী নেই, ৪-৫ বছর আগে মারা যায়।
জয়গনের মতো আরেক ভুক্তভোগী ধোপাকান্দি ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামের নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী সাবিত্রী রানী।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভোটার হালনাগাদ মৃত তালিকায় আমাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গত ১৯ মার্চ মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারি। পরে নির্বাচন অফিসে গেলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জীবিত থাকার সনদপত্রসহ আবেদন করতে বলা হয়।
এরপর ধোপাকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে গত ২০ মার্চ মৃত থেকে জীবিত হওয়ার প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করেন।
সেই প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, সাবিত্রী রানী মারা যাননি।
সে অত্র ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা এবং জন্মসূত্রে সে বাংলাদেশের স্থায়ী একজন নাগরিক।
তিনি স্বশরীরে ইউপি অফিসে হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি জীবিত আছেন।
অতএব তিনি বেঁচে আছে, ভোটার তথ্য হালনাগাদে এমন ভুয়া তথ্য সংশোধন করে তাকে হয়রানি থেকে মুক্ত করা হোক।
আরো যা হয়েছে –
একইভাবে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের জোত বিষ্ণুপুর গ্রামের নিতাই দাসের ছেলে দীপক দাস, গান্দাইল গ্রামের আবু হানিফা ও মনতলা গ্রামের রোকেয়া বেগম ও পৌরসভার গাংগাপাড়া গ্রামের আমান আলীর ছেলে শাফিকুল ইসলামসহ এ রকম ২৭ জন ব্যক্তিতে ভোটার তথ্য হালনাগাদে ১২ নং ফরমে মৃত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করায় স্কুল-কলেজে সন্তানদের ভর্তি, বয়স্ক ভাতার টাকা উঠানো, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা এবং ব্যাংক সেবাসহ জরুরি নানান কাজ থেকেও মাসের পর মাস ধরে বঞ্চিত হয়েছে তারা।
এছাড়াও এমন ভুয়া তথ্যের ফলে জীবত থেকেও মৃত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভাতা বা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা তুলতে না পেরে হয়রানির শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা।
এনিয়ে উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সংশোধন বিশেষ ফরমে আবেদন করে মৃত তালিকা থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করে জীবিত হতে সক্ষম হয়েছেন।
ডাটাবেইজে ভুলেভরা তথ্যে শিকার অন্যান্যরাও মৃত থেকে জীবিত হওয়ার আবেদন করলে ইউনিয়ন পরিষদ, নির্বাচন অফিসসহ সংশ্লিষ্টরা ভুল সংশোধনে সহযোগিতা করছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কথা –
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার জন্য সরকারি নিয়ম মোতাবেক মাঠকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়।
নিয়োগপ্রাপ্তরা সবাই ছিলেন স্কুল শিক্ষক।
তাদেরকে সম্মানজনক সম্মানি, তথ্য হালনাগাতে প্রশিক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে তাদের কাজের নিয়মাবলি শিখিয়ে দেওয়া হয়।
পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করেন।
কিন্তু তারা দায়িত্বে গাফিলতি করায় এমন ভুল করে জীবিত ব্যক্তিদের মৃত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তিনি আরও বলেন, ২০০৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এ উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ২৭ জন জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানো হয়; অথচ পরে জানতে পারি তারা জীবিত আছে।
পরে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে জীবিত করা হয়েছে।
এছাড়াও ২০২২ তথ্য হালনাগাদে আরও ২০৩ টি ডাটাবেইজের তথ্য ভুল রয়েছে।
জীবিত ব্যক্তিরা মৃত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাদের সঠিক ডাটাবেইজ খুঁজে বের করে জীবিত (সংশোধন) করার চেষ্টায় কাজ করছি। আশা করছি দ্রুত তারা জীবিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আসফিয়া সিরাত বলেন, ভোটার হালনাগাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা ২০৩ জন বিভিন্ন বয়সী জীবিত ব্যক্তিকে মৃত হিসেবে ভোটার হালনাগাদ তালিকায় ১২ নং ফরমে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
ইতিমধ্যে ২৭ জনের ডাটাবেইজ এ পর্যন্ত সংশোধন করা হয়েছে।
এনিয়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে ভোটার হালনাগাদের ডাটাবেইজ দেখে তা যাচাই-বাছাই করে তথ্য সংগ্রহকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।