রোগী সেজে থাকার দিন শেষ টাঙ্গাইল কারাগার হাসপাতালে

নিজস্ব প্রতিবেদক : কারাবন্দী বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি শীর্ষ অপরাধীদের জন্যে লোভনীয় একটি স্থান কারাগার হাসপাতাল। রোগী না হয়েও সুস্থ ও স্বাভাবিক একজন কারাবন্দী কারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রোগী সেজে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করা যেন একটি স্বাভাবিক বিষয় ছিল এই কিছুদিন আগেও। চিত্রটা দীর্ঘদিনের।

কিন্তু বর্তমানে সে চিত্র পুরোটাই পাল্টে গেছে। এখন আর প্রকৃত রোগী ছাড়া কারাবন্দী কোন ব্যক্তির কারা হাসপাতালে থাকার সুযোগ নেই। হাসপাতালে থাকতে হলে তাকে অবশ্যই কারাবিধি মেনে শুধুমাত্র রোগীর থাকার সুযোগ রয়েছে। যত প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোক না কেন নিয়মের ব্যত্য়য় ঘটিয়ে কারো কারা হাসপাতালে থাকার সুযোগ নেই এখন। আর টাঙ্গাইল জেলা কারাগারের এই সফলতা আনতে গিয়ে অনেক সময় নানা চাপের মুখে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে কারা প্রশাসনকে। কারা হাসপাতালের চিরাচরিত চিত্র পাল্টানোর পেছনে যে কয়জন কর্মকর্তা পরিশ্রম করেছেন তারমধ্যে অন্যতম ভুমিকা পালন করেছেন কারা চিকিৎসক ডা. মো. আবিবুর রহমান।

টাঙ্গাইল জেলা কারাগার সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারী ডাক্তার আবিবুর রহমান কারা চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে প্রায় সাড়ে চার বছর তিনি টাঙ্গাইল পুলিশ লাইনে দায়িত্ব পালন করেছেন। কারাগারে কয়েদী ও হাজতি ছাড়াও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিকিৎসা সেবা দেয়াই হচ্ছে কারা চিকিৎসকের প্রধান দায়িত্ব। দায়িত্ব নিয়েই ডাক্তার আবিবুর রহমান কারা হাসপাতালে প্রকৃত হাজতি ও কয়েদিদের ভর্তি করানোর পদক্ষেপ গ্রহন করেন। প্রাথমিকভাবে কাজটি অতটা সহজ ছিলনা। তবে কারা তত্ত¡াবধায়কসহ অন্যান্য কর্মকর্তার সহযোগিতায় অবশেষে সফল হন তিনি।

টাঙ্গাইল কারা হাসপাতালে মোট বেড ২৪টি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভর্তি থাকত ৩০/৩৫ জন। যাদের অধিকাংশই প্রকৃত রোগী ছিলনা। সুস্থ ও সবল দেহে শুধুমাত্র অর্থ আর ক্ষমতার জোরে হাসপাতালে জায়গা করে নেয় তারা। এদেরকে সরিয়ে প্রকৃত রোগীদের জায়গা করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন ডাক্তার আবিবুর রহমান। বর্তমানে কারা হাসপাতালে প্রকৃত রোগীরাই অবস্থান করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ডাক্তার আবিবুর রহমান প্রতিবেদককে জানান, যদি মনে করা হয় একজন কারাবন্দীর হাসপাতালে ভর্তি থাকা প্রয়োজন তখন তাকে শারিরীক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে হাসপাতালে রাখা হচ্ছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা অর্থের লোভ দেখিয়ে এখন আর কারা হাসপাতালে থাকার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে কোন প্রভাবশালী মহলের চাপের সাথে সমঝোতা করা হচ্ছে না। ব্যাথানাশক ও ঘুমের ঔষুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যাথানাশক ও ঘুমের ঔষুধ দিয়ে বিভিন্ন কারাবন্দী ও হাজতীরা নেশার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করত বলে এমন একাধিক তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ভাল বিছানা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, খাওয়া দাওয়া ও গোসলের সু-ব্যবস্থার কারণে কারা হাসপাতাল অনেকটাই লোভনীয় বিষয় কারাবন্দীর কাছে।

কারা সূত্র জানায়, হাসপাতাল বর্তমান অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। যেমন- ওষুধের অপব্যবহার বন্ধ করতে একজন রোগী ওষুধ নেয়ার পর সেই ওষুধের খোসা জমা দিয়ে পুনরায় ওষুধ গ্রহন করতে পারবে। এছাড়াও অপ্রয়োজনে কাউকে ওষুধ দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও আরো কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কারনে হাসপাতালে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে।

এদিকে করোনার ভয়াবহতা শুরুর পরপরই কারা হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা করা হয়। যার ফলে এখনো পর্যন্ত কারাগারে কোন করোনা সংক্রমনের মত ঘটনা ঘটেনি। করোনা উপসর্গ দেখা দেয়ার পর বেশ কয়েকজন কারাবন্দির পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ আসে। কঠোর নজরদারির কারণে টাঙ্গাইল জেলা কারাগার এখনো পর্যন্ত করোনামুক্ত অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে কারা কতৃপক্ষ।

কারা অভ্যন্তরে অবস্থিত হাসপাতালে দীর্ঘদিনের এই অনিয়ম এত অল্প সময়ের মধ্যে দুর করা কিভাবে সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল কারাগারের জেল সুপার মো. আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, কোন কিছু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিজস্ব সৎ ইচ্ছাই যথেষ্ট। রাজনৈতিক বা অন্য কোন চাপ আসতেই পাড়ে সে ক্ষেত্রে তাদের বুঝানোর মতো নিজস্ব কিছু উপস্থাপনা থাকতে হবে। সঠিক ভাবে তাদের বুঝাতে পারলেই সব কিছুই সহজ ভাবে করা সম্ভব।

এময় তিনি আরো জানান, এ ক্ষেত্রে টাঙ্গাইল কারাগারের জেলার মো. আমান উল্লাহ, ডা. আবিবুর রহমান-এর সহযোগিতার রয়েছে। তাদের কারণেই জেলা কারাগার হাসপাতালের সকল অনিয়ম দূর করা সম্ভব হয়েছে। এখানে কর্মরত সকলেই অনিয়মের বিপক্ষে থাকায় জেলা কারাগারের চিত্র এখন পরিবর্তন হয়ে সকলের সামনে পরিস্কার হয়েছে। তবে কিছু লোক আছে যারা বিভিন্ন ভাবে ধান্দা করার চেষ্টায় থাকে। পর্যায়ক্রমে তাদেরও বিভিন্ন ভাবে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এখানে কোন অনিয়মের সুযোগ নেই। সুতরাং সব কিছুর মূলে নিজের সৎ ইচ্ছা। সকলের সহযোগিতা আর অর্থের লোভ সামলাতে পারলে আগামী দিনগুলোতেও কারা হাসপাতালে প্রকৃত রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাবে। একইসাথে কারা হাসপাতাল নিয়ে মানুষের মাঝে নেতিবাচক ধারনার পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন টাঙ্গাইলের অভিজ্ঞমহল।