বিজ্ঞানীদের এই দলটি কাজ করছেন ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স নামের একটি মার্কিন এনজিওর হয়ে। অচেনা ভাইরাস শনাক্ত করে মহামারী ঠেকানোর চেষ্টাই তাদের কাজ।
বিশেষায়িত এই সংস্থার হলেন প্রধান পিটার ডাসজাক, যার নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের দলটি মাথায় আটকানো হেলমেটের বাতি জ্বালিয়ে বাদুড়ের ডেরার মুখে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে জালের ফাঁদ পেতে চলেছে।
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উহান প্রদেশে চুনাপাথরে গড়া গুহায় বিজ্ঞানীদের হানা দেওয়ার এই রোমাঞ্চকর বর্ণনা উঠে এসেছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে।
সূর্যাস্ত হতেই খাবারের খোঁজে ডেরা ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে শুরু করে হাজার হাজার বাদুড়। কিন্তু গুহার বাইরে ডাসজাকের দলের বানানো জালের ফাঁদে আটকা পড়ে তারা।
বিজ্ঞানীরা এরপর জাল গুটিয়ে আনেন, মৃদু চেতনানাশক ব্যবহার করে আটকা পড়া বাদুড়ের দলটিকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। তারপর বাদুড়ের ডানার ধমনী থেকে সংগ্রহ করেন রক্ত।
বাদুড়ের মুখের লালা এবং মলও এ সময় সংগ্রহ করা হয় বলে জানান ডাসজাক।
তাকে একজন ‘ভাইরাস শিকারি’ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সিএনএন। নতুন কোনো রোগের কারণ হতে পারে এমন প্যাথোজেনের তালাশে গত ১০ বছরে ২০টি দেশে বাদুড়ের ডেরায় ডেরায় ঘুরেছেন এই বিজ্ঞানী।
উদ্দেশ্য একটাই, হঠাৎ মহামারীর মত ছড়িয়ে বিশ্বকে কাবু করার আগেই প্যাথোজেনকে শনাক্ত করা। মূলত করোনাভাইরাসের বিভিন্ন প্রজাতির খোঁজে রয়েছেন ডাসজাক।
তিনি বলেন, “আমরা এর মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি নমুনা নিয়েছি বাদুড় থেকে; আর সেখান থেকে ৫০০ রকমের নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত করেছি।”
এর মধ্যে একটি নতুন করোনাভাইরাস তারা ২০১৩ সালে চীনের এক গুহায় পেয়েছিলেন, যেটি কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী ভাইরাসের পূর্বসূরী হয়ে থাকতে পারে।
করোনাভাইরাসের খোঁজে
ষাটের দশকে দুই ধরনের করোনাভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলো মানুষে সংক্রমিত হয়। কিন্তু ২০০৩ সালে সার্স মহামারীর আগে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা খুব বেশি আগ্রহ জাগায়নি।
ভাইরোলজিস্ট ওয়াং লিনফার ভাষায়, মেডিকেল গবেষণায় করোনাভাইরাস তেমন কোনো আবেদন জাগাতে পারেনি।
ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স যেসব নমুনা সংগ্রহ করে, সেগুলো বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত ‘টুল’ সিঙ্গাপুরের ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুলের গবেষক ওয়াং লিনফারই তৈরি করে দিয়েছেন।
২০০৯ সালে ইউএসএআইডির তহবিলে একটি বিশেষ প্রকল্প শুরু করে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস, ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স, স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউট, ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি এবং ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি মেটাবলিয়া, যারা একটি এপিডেমিক ট্র্যাকার তৈরি করেছে।
তাদের ওই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ‘প্রেডিক্ট’। প্রাণী থেকে মানুষে ছড়াতে পারে, এমন নতুন ধরনের রোগ ও এর জন্য দায়ী ভাইরাস শনাক্ত করাই এর কাজ, যা করতে হবে রোগী মানুষের দেহে ছড়াতে শুরু করার আগেই।
যাত্রা শুরুর পর গত দশ বছরে ২০ কোটি ডলারের তহবিল পেয়েছে এ প্রকল্প। আর গবেষকরা শনাক্ত করেছেন নতুন পাঁচ ধরনের করোনাভাইরাস, যেগুলো মহামারীর কারণ ঘটাতে পারে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী নতুন করোনাভাইরাসও রয়েছে।
পিটার ডাসজাক বলছেন, বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড় ১৫ হাজার রকমের করোনাভাইরাসের পোষক হিসেবে কাজ করে, তার মধ্যে মাত্র কয়েকশর তত্ত্ব-তালাশ মানুষ এ পর্যন্ত জানতে পেরেছে।
ডাসজাকের সংস্থা চোখ রেখেছিল চীনের ইউনান প্রদেশের পাহাড়ি এলাকায় ওই চুনাপাথরের গুহার দিকেই, কারণ সেখানে রয়েছে বাদুড়ের বিরাট বসতি।
“আমরা চীন থেকে গবেষণা শুরু করেছিলাম, কারণ সার্সের উৎস খোঁজাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। তারপর আমরা বুঝতে পারি, করোনাভাইরাসের আরও শত শত ধরন রয়েছে যা মানুষের জন্য বিপজ্জনক, তখন আমরা সেগুলো খুঁজে বের করতে মনোযোগ দিই।”
প্রেডিক্ট যে ৩১টি দেশে কাজ করেছে, তার মধ্যে মিয়ানমার ও কেনিয়া থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করেছে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রামের একটি দল।
সেই দলের নেতৃত্ব দেওয়া সুজান মারে বলেন, এখন পর্যন্ত তারা মিয়ানমারে ছয় ধরনের করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে পেরেছেন।
“এখানে অনেক এলাকায় জীববৈচিত্রের প্রাচুর্য আছে। জনসংখ্যা যত বাড়ছে, বুনো প্রকৃতি ঘেঁষে তাদের বসতি গড়ে উঠছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হচ্ছে, গবাদি পশুর সংখ্যাও প্রচুর। সব মিলিয়ে প্রাণী থেকে মানুষে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি।”
পিটার ডাসজাক বলেন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও চীনে বহু মানুষ নিয়মিতভাবে বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসে। তারা শিকার করে, বাজারে বিক্রি করে, খায়। সে কারণে ওই এলাকাগুলোতে তারা ভাইরাসের খোঁজে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন।
২০১৫ সালে চীনের ইউনান প্রদেশের জিনিং কাউন্টির দুটি বাদুড়ের গুহার কাছাকাছি লোকালয়ের বাসিন্দাদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ডাসজাকের দল দেখতে পায়, তাদের তিন শতাংশের শরীরে এমন ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, যা সাধারণত বাদুড়ের শরীরে পাওয়া যায়।
“তারা হয়ত নিজের অজান্তেই ওই প্যাথোজেনের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং সেরেও ওঠেন। অথবা তাদের শরীরে হয়ত সংক্রমণের মাত্রা ছিল মৃদু।”
বাদুড়ের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করার পর তা তরল নাইট্রোজনে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইকোহেলথ অ্যালায়েন্সের সহযোগী ল্যাবে গবেষণার জন্য পাঠানো হয় সেই নমুনা।
ডাসজাক বলেন, “আমরা সাধারণত কোনো দেশের সেরা পরীক্ষাগারটি বেছে নিই কাজ করার জন্য। যদি তেমন কিছু না থাকে, তাহলে স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা তৈরি করে নিতে হয়।”