নিজস্ব প্রতিবেদক : টাঙ্গাইল পৌর ভবনের সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিকৃত ভাস্কর্য নির্মাণের পর তা রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার প্রায় নয় মাস পেরিয়ে গেলেও পুনরায় তা নির্মাণের উদ্যোগও নেয়া হয়নি।
ভাস্কর্যটি কি কারণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, তা নিয়ে পৌরবাসীর কাছে কোন ব্যাখ্যা দেননি পৌর কর্তৃপক্ষ।
এমনকি পৌরসভার মেয়র বিষয়টি এখনো খোলাসা করেননি আনুষ্ঠানিকভাবে। ফলে এ নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভাস্কর্য নির্মাণের পর তা অপসারণের ঘটনাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবজ্ঞা বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
জানা গেছে, বিগত ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারী টাঙ্গাইল পৌরসভার নির্বাচনে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এসএম সিরাজুল হক আলমগীর।
নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি পৌরভবনের সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেন। পৌরসভার সকল কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে আলাপ আলোচনার পর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন মেয়র।
পৌরসভা সুত্রে জানা যায় –
২০২১ সালের ২৭ জুলাই মঙ্গলবার টাঙ্গাইল পৌরসভার অর্থায়নে পৌরভবনের সামনে ১৫ ফুট উচ্চতার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ কাজের শুভ উদ্বোধন করেন মেয়র এস,এম সিরাজুল হক আলমগীর।
এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খান, পৌরসভার সকল প্যানেল মেয়র, কাউন্সিলর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
নির্মাণ কাজ উদ্বোধনের দিন পৌর মেয়র সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পৌরসভার সামনে জাতির পিতার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছে।আরো
টাঙ্গাইল পৌরসভার নিজস্ব প্রকৌশলী দিয়ে সঠিক নিয়মনীতি মেনে এর ডিজাইন করা হয়েছে।
আরো পড়ুন – টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক খন্দকার রফিকুল আলম আর নেই
ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি সে সময় সকলের পরামর্শ ও সহযোগিতার কামনা করেন উদ্বোধনের দিন।
ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ শুরু করার দুই মাস পর প্রায় ছয় ফুট পর্যন্ত কাজ হয়। এরপর হঠাৎ এক রাতের আধাঁরে তা ভেঙ্গে ফেলা হয়।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের পর দেখা যায় তা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অবয়ব ফুটে উঠেনি; অসম্পূর্ণ বিকৃত অবয়বের সৃষ্টি হয়।
এ নিয়ে সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
অনেকে বিকৃত অবয়বের ছবি প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চাপের মুখে পৌর কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ করতে বাধ্য হয়।
এরপর ভাস্কর্যটি পুনরায় নির্মাণের কোন উদ্যোগ এখনো নেয়নি পৌরসভা।
অভিযোগ সমুহ –
এ ব্যাপারে অনেকের অভিযোগ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মানের জন্যে মেয়র পেশাদার কোন ভাস্কর শিল্পী নিয়োগ না করে মৃর্তি বানানোর একজন সাধারণ কারিগর নিয়োগ করেন। ফলে যা হবার তাই হয়।
আরো পড়ুন – টাঙ্গাইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাড়ছে কিশোর মৃত্যুর সংখ্যা
ভাস্কর্যটি নির্মানের শেষ পর্যায়ে এসে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত চেহারা ভাস্কর্যে ফুটে উঠেনি। বরং অনেকটা বিকৃতভাবে ফুটে উঠেছে এটি।
এ ঘটনা জানাজানির পর পৌরসভার মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীর তড়িঘড়ি ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ এক নেতা বলেন, পৌরসভার বিপুল অর্থ ব্যয় করে জাতির জনকের বিকৃত ভাস্কর্য নির্মাণ বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানোর পরিবর্তে তাকে অবমাননা করার সামিল।
তাছাড়াও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। তাকে নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত পৌরসভা এককভাবে নিতে পারেনা।
ভাস্কর্য নির্মাণের ব্যাপারে সকলের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ ছিল।
এ ব্যাপারে খেতাবপ্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, জাতির জনক আমাদের অহংকার।
তার নির্দেশে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে অস্ত্রহাতে পাকিস্থানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
তাই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে কোন গাফিলতি মেনে নেয়া আমাদের জন্যে কষ্টকর বিষয়।
বিকৃত অবয়বের ভাস্কর্য নির্মাণের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা সোচ্চার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাংস্কৃতিক ও নাট্যকর্মী সাম্য রহমান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাতির জনকের ভাস্কর্য নির্মানের বিষয়টি নিয়ে যারা ভাস্কর্য শিল্পে অভিজ্ঞ তাদের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ ছিল; আমি জানিনা মাননীয় মেয়র সাহেব তা করেছিলেন কিনা।
তাছাড়া বিকৃত ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে ব্যয় হওয়া পৌরবাসীর করের এই বিপুল পরিমান অর্থ অপচয়ের দায়ভার এখন কে নিবে।
এসময় তিনি আরো বলেন, ভাস্কর্য তৈরির ক্ষেত্রে একটি মাপ আছে, সেই মাপ অনুসারে করা হয়নি।
ভাস্কর শিল্পীর কথা –
এ ব্যাপারে প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় ভাস্কর্য নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া টাঙ্গাইল সদর উপজেলার তারুটিয়া এলাকার দুলাল পালের সাথে।
মুঠোফোনে তিনি প্রতিবেদককে জানান, আমি চারজন কারিগর নিয়ে দুইমাস কাজ করেছিলাম।
মুজুরী বাবদ আমাকে দুইলাখ টাকা দেয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ৩২ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
ভাস্কর্য নির্মাণে তার কোন অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে দুলাল পাল বলেন, আমি সিমেন্টের মুর্তি তৈরি করি; আমি কখনো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করিনি।
জাতির জনকের ভাস্কর্য নির্মাণ ও পরে তা অপসারণের ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে পৌরবাসীর মাঝে।
এভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ ও অপসারণ ফেলার বিষয়টি অনেকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছেননা।
বিষয়টি কেন এতদিনেও মেয়র মহোদয় পৌরবাসীকে খোলাসা করে জানাননি তা নিয়েও অভিযোগ অনেকের।
পৌর মেয়রের বক্তব্য –
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ ও অপসারণের ব্যাপারে জানতে চাইলে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এসএম সিরাজুল হক আলমগীর বলেন, আসলে ভাল কারিগর পাওয়া মুসকিল।
যারা আমাদের বঙ্গবন্ধুর ভাল ভাস্কর্য বানানোর প্রতিশ্রতি দিয়েছিল তা হয়নি। কিছুটা ত্রুটি বিচ্যুতি থাকায় আমরা তা অপসারণ করেছি।
আগামীতে নিরালা মোড়ে যদি আমরা স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ করতে পারি; সেখানে জাতির জনকের নান্দনিক পরিবেশে বঙ্গব্ন্ধুর ঐতিহাসিক একটি ভাস্কর্য স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছি।
এছাড়া আপাতত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
তিনি বলেন ভাস্কর্য নির্মাণে পৌরসভার একটি পয়সাও খরচ হয়নি। যেহেতু আমি সাকসেস হইনি সেহেতু ভাস্কর্য নির্মাণে খরচ সম্পূর্ণই আমার পকেটের টাকা।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও টাঙ্গাইলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোন ভাস্কর্য স্থাপনের কোন উদ্যোগ নেয়নি কেউ।
আগামীতে শহরের কোন সুন্দর পরিবেশে বা সুন্দর জায়গায় জাতির জনকের একটি চমৎকার ভাস্কর্য নির্মাণ করার দাবি রয়েছে নতুন প্রজন্মের। সম্পাদনা – অলক কুমার