টাঙ্গাইলে মহাসড়ক নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপূরনের টাকা পেতে এলএ শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের চাহিদামত টাকা না দেওয়ায় শতশত গ্রাহক মাসের পর মাস ঘুরেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। আবার অনেক গ্রাহক ক্ষতিপূরণের চেক দ্রুত পাওয়ার আশায় অগ্রিম টাকা দিয়েও চেক না পেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। আর এই সিন্ডিকেটের মূল হোতাই হচ্ছেন খোদ ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার। আর তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন অফিসের নাজির নজরুল ইসলাম, সার্ভেয়ার কামরুল আলম ও অফিস সহায়ক আব্দুল।
যা যা ঘটেছে –
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৬/৭ বছর আগে মির্জাপুর উপজেলার ধেরুয়া মৌজার আ. রাজ্জাকসহ ১৯ জনের ১৫ একর জমি অধিগ্রহন করে সরকার। এরপর স্থানীয় সুরুজ মিয়া নামের এক ব্যক্তি ওই অধিগ্রনকৃত জমি নিজের দাবি করে মিস কেস দায়ের করেন। যার নম্বর ১৩/২০১৬-১৭। পরবর্তীতে আদালত সকল কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বাদির দায়েরকৃত মামলা খারিজ করে দেন এবং রাজ্জাকসহ ১৯ জনকে ক্ষতিপূরনের ৫৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৯২/৫৭ টাকা প্রদানের জন্য আদেশ দেন।
এরপর থেকেই ওই গ্রাহকদের কাছ থেকে এলএ শাখার নাজির নজরুলসহ সিন্ডিকিটের সদস্যরা অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অফিসের নাজির নজরুল ইসলাম ক্ষতিপূরনের চেক দ্রুত দেওয়ার কথা বলে রাজ্জাকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন এক লাখ ৮০ হাজার টাক। এর কিছুদিন পর আবার ৫ লাখ টাকা দাবি করেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। কিন্তু এতে রাজি না হওয়ায় পূনরায় সুরুজকে দিয়ে মিস কেস করান নজরুল। এরপর আদালত পূর্বের রায় বহাল রেখে গ্রাহকদের টাকা প্রদানের আদেশ দেন। তাতেও কোন কাজ না হওয়ায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভূক্তভোগীরা।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিন এলএ শাখায় গিয়ে কথা হয় আব্দুর রাজ্জাক ও ইনতাজ আলীর সাথে। তারা জানান, র্দীঘ ৫/৬ বছর ধরে ক্ষতিপূরনের চেকের জন্য ঘুরছেন। এক লাখ ৮০ হাজার টাকাও নিয়েছেন নাজির নজরুল ইসলাম। তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না। তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন এজন্য পাঁচ লাখ টাকাও চেয়েছেন নজরুল। সেই টাকা না দেওয়ায় এখন বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে চেক পাওয়ার জন্য। আর আসলেই তারা নজরুল বলেন মামলা চলছে, আবার ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা বলেন কাল বা পরশু আসেন, আর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তাদের জানিয়েছেন আগামী ১৭ মার্চ দেখা করতে। এভাবেই বছরের পর বছর ঘুরে চেক না পাওয়ার আশাই ছেড়ে দিয়েছেন তারা। শুধু রাজ্জাক নয়। এরকম শতশত গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে রেখেছেন এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এমনটাই অভিযোগ ভ‚ক্তভোগি গ্রাহকদের।
ভূক্তভোগীদের অভিযোগ –
নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়ার জিন্না খান। তার মাত্র দুই লাখ টাকার ক্ষতিপূরনের চেকের জন্য নজরুল ৩০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করেছেন। সেই টাকা না দেওয়ায় এখনো সেই ক্ষতিপূরনের চেক দেওয়া হয়নি জিন্নাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলএ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ক্ষতিপূরনের চেক পেতে হলে গ্রহকদের অফিসের নিয়ম অনুযায়ী ৮ থেকে ১৫ শতাংশ টাকা দিতেই হবে। অনেক ক্ষেত্রে ২০ শতাংশও আদায় করা হয়। আর এসব টাকা নিচ থেকে শুরু করে উপর পর্যন্ত ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে। আবার যে গ্রাহক অতিরিক্ত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাদের চেক পেতে অনেকটা বেগ পেতে হয়। পরবর্তীতে তারা বাধ্য হন টাকা দিতে।
অভিযোগ উঠেছে ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা ফারজানা আক্তারের সহযোগিতায় এসব কর্মকান্ড চালাচ্ছে অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। আর ওই কর্মকর্তাই ঠিক করে দেন কোন গ্রাহককে চেক দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না। আর এতে সহযোগিতা করেন অফিসের নাজির নজরুল ইসলাম, সার্ভেয়ার কামরুল আলম ও অফিস সহায়ক আব্দুল। আর তাদের সহযোগিতা করেন দালাল কাজিপুরের ইসমাইল হোসেন। সিন্ডিকেটের সদস্যরা গ্রাহকের কাছ থেকে চাহিদামত টাকা পাওয়ার পর ফারজানা আক্তারের কাছে যান ফাইলে স্বাক্ষর করাতে। এরপর তিনিও (ফারজানা) হিসাব বুঝে পেয়ে ফাইলে স্বাক্ষর করেন।
ক্রয়কৃত জমি লিজ দেখানোর অভিযোগ ফারজানার বিরুদ্ধে :
ঢাকার ধামরাই থানার বাগ নগর গ্রামের মো. কামাল হোসেন আশুলিয়া থানার গণকবাড়ী মৌজায় পাঁচ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি ও দোকান ঘর স্থাপন করে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। আর এই বাড়ির পাশ দিয়েই রয়েছে আট ফুট (বিএস নক্সায় সাত ফুট রাস্তা। এই রাস্তার উত্তর পাশেই ধামরাইয়ের তৎকালিন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তারের বাড়ি। তার বাড়িতে ব্যক্তিগত গাড়ি ও ট্রাক চলাচলের জন্য রাস্তা প্রসস্ত করতে মো. কামাল হোসেনকে জায়গা ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু এতে তিনি রাজি না হওয়ায় তৎকালীন আশুলিয়া উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) সহযোগিতায় ক্রয়কৃত জমি লিজ দেখিয়ে ভেঙে ফেলে ১৩ ফুট রাস্তা নির্মানের পায়তারা শুরু করে। এতে বাঁধা দেওয়ায় ২০২২ সালের ৯ জুন মো. কামাল হোসেনকে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে অফিসের সরকারি নম্বর থেকে (০১৯৩৩৪৪৪০৩৯) মেরে লাশ গুম করারও হুমকি দেন ফারজানা আক্তার। পরে ওইদিনই মো. কামাল হোসেনের ছেলে মো. মনিরুজ্জামান ঢাকার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
নাজির নজরুল ও ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা ফারজানার বক্তব্য –
এলএ শাখার নাজির নজরুল ইসলামের মন্তব্য জানতে একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে এ বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা ফারজানা আক্তার জানান, তিনিসহ অফিসের কেউ এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত নন। তবে যদি কেউ গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকেন তাহলে সেই গ্রাহক লিখিত কোন অভিযোগ দিলে তাদের (কর্মকর্তা-কর্মচারি) বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আশুলিয়ার ঘটনা বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে যেটুকু করা হয়েছে, তা তুলনামূলক কমই করা হয়েছে। আরো বেশি কিছু করার প্রয়োজন ছিল। আমাদের যেটুকু উদ্ধার করার কথা তা করা হয়নি। তবে এ বিষয়ে তৎকালীন সহকারী কমিশনার ভূমিই ভালো বলতে পারবেন।