নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ।
এরই মধ্যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন ও তাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে।
সেই মন্ত্রসভায় নতুন অনেকেই ডাক পেয়েছেন আবার পুরাতন অনেক হেভিওয়েট মন্ত্রী বাদ পড়েছেন।
নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন আগের মন্ত্রিসভার ১৪ মন্ত্রী, ১২ জন প্রতিমন্ত্রী ও দুইজন উপমন্ত্রী।
আরো পড়ুন – অজ্ঞাত কারণে সামনে আসেনি কালিহাতী উপজেলা আ’লীগের অনুমোদিত কমিটি
বিভিন্ন সময় তাঁদের কর্মকাণ্ডে নানান বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, সেজন্য নতুন মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
দ্বাদশ মন্ত্রিসভায় নতুন মন্ত্রী মন্ত্রীদের মধ্যে বাদ পড়েছেন টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ৫ বারের সংসদ সদস্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক।
আব্দুর রাজ্জাক শুধু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শুধু মন্ত্রীই ছিলেন না, দলের ভেতরেও গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
এবার মন্ত্রীসভায় তার স্থান না হওয়ায় রাজনৈতিক মহল ও তার নিজ জেলা টাঙ্গাইলে নানান গুঞ্জন রয়েছে। অনেকেই এই বাদ পড়াকে একটি নক্ষত্র ঝড়ে পড়ার সাথে তুলনা করছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৪ এর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ণ কমিটির আহবায়ক ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক।
২০০৯ সালে তিনি খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি আবারো ফিরে আসেন মন্ত্রীসভায়।
ড. আব্দুর রাজ্জাকের মন্ত্রীত্ব হারানোয় তাঁর নিজ নির্বাচনী এলাকাসহ পুরো জেলায় চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
তাঁর অনুসারীরা হতাশায় পড়লেও রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মহল খুশি। মন্ত্রীত্ব না পাওয়ায় অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম স্ট্যাটাস দিয়ে যেমন আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে, তেমনি আর সমর্থকেরা প্রকাশ করছেন তাদের কষ্টের প্রতিক্রিয়া।
আব্দুর রাজ্জাকের মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার পেছনে যেসকল বিষয় কাজ করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা –
একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকার –
দ্বাদশ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য একরাতে সব নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়ে ড. রাজ্জাকের একটি সাক্ষাৎকার সরকার ও দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করে।
যা পরবর্তীতে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
আরো পড়ুন – মানুষের বিশ্বাস, আস্থা ও ভরসায় বিজয়ী হয়েছেন ছানোয়ার
ওই সময় তিনি তার বক্তব্যের স্বপক্ষে যুক্তি ও উদাহরণও দেন। এমনকি পরেও তিনি তার ওই বক্তব্যে অটল থেকে বক্তব্য প্রদান করেন।
আবদুর রাজ্জাক সাক্ষাৎকারে বলেন, সহিংসতা আটকাতে পরিকল্পিতভাবেই জেলে রাখা হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদের।
২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার না করলে হরতালে গাড়ি চলত? গণগ্রেপ্তার ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না।
যেটাই করা হয়েছে আমরা চিন্তাভাবনা করেই করেছি।
বিএনপিকে ভোটে আনার সব চেষ্টাই হয়েছে এবং একরাতেই সব নেতার মুক্তির প্রস্তাবেও রাজি হয়নি দলটি।
এই বক্তব্যে রাজনৈতিক মহল উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
সে সময় দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কৃষিমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে তার ব্যক্তিগত এবং দলীয় নয় বলে দাবী করেন।
নিজ আসনের নেতাকর্মীদের সাথে বিরোধ –
মধুপুর ও ধনবাড়ী এই দুইটি উপজেলা নিয়ে টাঙ্গাইল-১ আসন, ড. রাজ্জাকের নিজ নির্বাচনী এলাকা।
এই আসনের মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খন্দকার শফিউদ্দিন মনি ও সাধারণ সম্পাদক ছরোয়ার আলম খান আবুর সাথে ড. রাজ্জাকের চরম বিরোধ প্রকাশ্যে।
এই বিরোধের জের ধরে ড. রাজ্জাকের অনুসারীদের সাথে বিরোধী পক্ষের সংঘর্ষ মারামারির ঘটনাও ঘটে; যা এখনও চলমান।
ঘাটাইলের আইটি পার্ক স্থানান্তর –
প্রস্তাবিত শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার ঘাটাইলে নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণও হয়েছিলো।
সেই আইটি পার্কটি মধুপুরে স্থানান্তরে পর চরম বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনে আন্দোলন করে ঘাটাইলবাসী।
আরো পড়ুন – সমর্থকদের মুক্তির দাবিতে লতিফ সিদ্দিকীর থানা ঘেরাও
২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি হাই-টেক পার্কের অনুকূলে ১২ একর ৭৭ শতাংশ জমি বিনামূল্যে বরাদ্দ দেয়ার জন্য ঘাটাইল উপজেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের অনুমোদন দেওয়া হয়।
১ লাখ ১ হাজার টাকায় নামমাত্র মূল্যে উপজেলার সন্ধানপুর ইউনিয়নের গৌরিশ্বর মৌজায় ১২ একর ৭৭ শতাংশ খাস জমি অধিগ্রহণের কাজও শেষ হয়।
কিন্তু এক পর্যায়ে জানা যায়, একনেক সভায় অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছে ঘাটাইলের পরিবর্তে মধুপুরের নামে।
অভিযোগ উঠে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রভাব খাটিয়ে আইটি পার্কটি তার নির্বাচনী এলাকা মধুপুরে স্থানান্তর করেছেন।
পরে মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, আইটি সেন্টারটি ঘাটাইলে হওয়ার কথা তা তিনি জানতেন না।
এমপিদের সাথে উপজেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব তৈরি –
টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার প্রত্যেকটিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সাথে উপজেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে।
এমনকি নিজ আসনের মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাথে তাঁর সাপে-নেউলে অবস্থা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা জানিয়েছেন, কৃষিমন্ত্রী ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য এই দ্বিধা বিভক্তি তৈরি করে রেখেছেন।
তারা আরো জানান, নির্বাচনের আগে তিনি আটজন সংসদ সদস্য নিয়ে একটি মোর্চা (জোট) তৈরি করেছিলেন।
যা তিনি প্রত্যেকের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে তৈরি করেছিলেন বলে জানিয়েছেন তারা।
তারাই ফলশ্রুতিতে চরম দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও টাঙ্গাইলের আট সংসদ সদস্য বেশ কয়েকবার একই মঞ্চে উঠেন।
সেখানেও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাথে বিভক্তি স্পষ্ট করেছেন তিনি।
আরো পড়ুন – টাঙ্গাইলে দলীয় অফিস দুধ দিয়ে ধুয়ে পূণঃনির্বাচিত এমপির ছবি লাগালেন আ’লীগ নেতা
কিন্তু পরবর্তীতে সেই মোর্চাকে (জোট) তিনি শুধু নিজের মনোনয়ন নিশ্চিতের জন্য কাজে লাগান।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত দুইজন সংসদ সদস্য বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, একজন বিষয়টি নিয়ে কোন কথা বলেননি, চুপ ছিলেন।