সৃষ্টিকর্তার যে ক’টি অমূল্য নিয়ামত আমরা প্রায় বিনামূল্যে ভোগ করে থাকি- পানি তন্মদ্ধে অন্যতম। পানি প্রকৃতির অনন্য এক আধার। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ বাঁধাহীন পানির অধিকার ভোগ করে আসছে। আবার এই পানি নিয়ে যুদ্ধও হয়েছে ঢের। তাই অনেকেই বলে থাকেন আজকে বিশ্বব্যাপী তেল নিয়ে যে যুদ্ধ চলছে অদূর ভবিষ্যতে তা পানিতে গিয়ে ঠেকবে। আর তা অবশ্যই হবে মিঠা পানি নিয়ে। কাজেই পানি নিয়ে ইনসাফ আজ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত বটে। এই ইনসাফকে যারা অস্বীকার করে তারা মানবতার শত্রু। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়। মানবতার শত্রু, তা সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন তার পতনের নজির ইতিহাসে ভুরি ভুরি।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা আন্দোলনের ডাক দিয়ে বিশ্বজনমতের কাছে মানবতার এক অনন্য গীতিকাব্য রচনা করে গিয়েছিলেন। ভাসানীর এই ডাক কেবল ফারাক্কার ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ডাকই নয়। এই ডাক জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের টিকে থাকার ডাক। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতিকে এক হবার ডাক। জাতিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার ডাক। মাথা নত না করার ডাক। অধিকার আদায়ে বিশ্বজনমত গঠনের ডাক।
ভাসানীই প্রথম ফারাক্কা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের দেশকে মরুকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার করেছিলেন। ফারাক্কার রাজনৈতিক গুরুত্বকে ভবিষ্যত স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আমরা এখন ক্রমশই মরুকরণের পার্শ্বিকতা টের পেতে শুরু করেছি। আগুনের আঁচ টের না পেলে বাঙালি নাকি তেঁতে ওঠে না। বাঙালি এখন তার আঁচ পেতে শুরু করেছে। শুধু জেগে ওঠা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
পানির দাবীকে যারা ভারত বিরোধীতা কিংবা ভারত প্রীতির দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর কথা ভাবছেন। তাদেরও ঘুম একদিন হারাম হয়ে যেতে পারে মিঠা পানির অভাবে অথবা লবনাক্ত পানির দাপটে। এরই মধ্যে আমরা টের পেতে শুরু করেছি একদিকে অকাল বন্যা অন্যদিকে পানির জন্য হাহাকারে। তাই আমাদের এই বাঁচা মরার সমস্যাকে কেবলমাত্র রাজনৈতিক সমস্যা বলেও পাশ কাটিয়ে যাবার পথ নেই। কারণ আমরা যাদেরকে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিভু বানিয়ে তুষ্ট মনে দায়িত্বের শেষ ভাবছি, তাদের বেশিরভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিকল্প আবাসন গড়ে তুলেছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ জনতাকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা যারা ভাবছি এ দায়িত্ব আমাদের নয়, তারাই এদেশের নব্বই ভাগ মানুষ। তাই দায়িত্বটা আমাদেরকেই নিতে হবে।
পৃথিবীর কোন পরাশক্তিই অন্য জাতির ন্যায্য দাবী অগ্রাহ্য করে টিকে থাকতে পারেনি। সে যত ক্ষমতাশালীই হোক না কেন। বিশেষ করে ভারতের অভ্যন্তরেই যখন ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কথা উঠেছে। প্রতিবাদ হচ্ছে। জনমত গঠন হচ্ছে। মনে রাখতে হবে এ লড়াই কোন দেশ বা জাতির বিরুদ্ধে নয়। এ লড়াই মানুষ এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণের বিরুদ্ধে প্রকৃতিবাদীদের লড়াই। ভারতের নিপীড়িত জনতা আমাদের পাশে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। দু’ভাবেই আমরা এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে পারি। এক. কুটনৌতিক আলোচনা, দুই. আন্তর্জাতিক জনমত।
সবিশেষ ফারাক্কা লং মার্চকে যারা কেবলই একটি দিবস বা মিছিল বলে চালিয়ে দিতে চান, তারা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি এর অন্তর্নিহিত সক্ষমতা। তা না হলে আজও বাংলার আপামর জনতা ধারণ করতো না ফারাক্কার চেতনা। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মালিকরা আজ বুঝতে পারছে স্বাধীনতা কেবল ভৌগলিক অখন্ডতার আকাঙ্খা নয়। অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার নামই স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা এমন একটা জাতি যারা কোনদিন কারও শান্তি বিনষ্ট করিনি। কারও ভুখন্ডে শোষণ জুলুমের চেষ্টা করিনি। তাই অন্য কোন রাষ্ট্র, সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। পারবেও না ইনশাআল্লাহ। সময়ের প্রয়োজনে ফারাক্কা আন্দোলনের চেতনার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত হবে। আর সে দিন বেশী দুরে নয় যেদিন একটি হাত বল্লমের মতো ঝলসে উঠে বলবে- খামোশ।