টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মারামারির প্রতিশোধ নিতেই সজিব হোসেন (১৭) নামে এক কিশোরকে হত্যা করেছে অভিযুক্তরা। আর তার জন্য তিন বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। পরে “রশি বান ঝারা” দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো আলামিন (৩০), শামীম (২০), সাজ্জাত (২২), জুয়েল (২০) ও মনতাজ (২৮)। এদের প্রত্যেকের বাড়ি উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামে বলে জানা গেছে।
এই ঘটনায় আসামি আলামিন নিজেকে একক দোষী সাব্যস্ত করে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুমন কর্মকার এর আদালতে আসামি ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি মূলক জবান্দবন্দি প্রদান করে। আলামিন জানায়, অপহরণের দিন ২৫ সেপ্টেম্বরই তাকে হত্যা করে নদীর পারে বালি দিয়ে ঢেকে রাখে। পরে ২৯ সেপ্টেম্বর মরদেহটি নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় মানিকগজ্ঞ থানা পুলিশ উদ্ধার করে।https://youtu.be/ZoeIT33tnfA
আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত তিন বছর আগে নিহত সজিব ও তার বন্ধুরা আসামি আলামিন ও তার বন্ধুদের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পরে। ঐ ঘটনায় আলামিনের মাথা ফেটে যায়। চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস। এরপর আসামি আলামিন ঐ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে নিহত সজিবের সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। কিন্তু সজিব ঐ ঘটনা মনে রাখেনি বা তাকে চিনতে পারেনি। এভাবে তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আলামিন ঐ ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করে। আর পরিকল্পনা মোতাবেক গত ২৫ সেপ্টেম্বর (বুধবার) কৌশলে সজিবকে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে নিয়ে যায়।
এসময় আলামিন পূর্ব পরিকল্পনা মতো সাথে করে কয়েকটা ঘুমের ওষুধ নেয়। পরে লাউহাটি এলাকায় গিয়ে সজিবকে একটু দুরে রেখে সিগারেট ও জুস কিনে। আর জুসের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। আর সেই জুস সজিবকে খেতে দেয়। সজিব সরল বিশ^াসে জুস খাওয়ার পর মাথা ব্যথা ও ঘুমের ভাব চলে আসে। তখন সজিব মাথা ব্যথার কথা আলামিনকে বললে, আলামিন বলে, আমি একটা ঝারা জানি, “রশি বান ঝারা”। এই রশি বান ঝারা দিতে তো রশি লাগে কিন্তু রশি তো নাই। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে ঘোড়ার গাড়ি থেকে আলামিন রশি এনে সজিবের হাত-পা বেঁধে ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয়। হাত-পা বাঁধার সময় সজিব আলামিনকে জিজ্ঞেস করে, “ভালো হবে তো বন্ধু?” উত্তরে আলামিন বলে, সব ভালো হয়ে যাবে। কোন ব্যথা থাকবে না।
এরপর যখন সজিবকে নদীতে ফেলে দেয়া হয় আর সজিব মারা যাচ্ছিল না, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাঁতরে তীরের দিকে আসতে থাকে তখন আলামিন প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরে নদীতে নেমে জলে ডুবিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারপর সজিবের লাশ তীরে বালি দিয়ে ঢেকে রেখে আলামিন পালিয়ে যায়। আর পালিয়ে যাওয়ার সময় সজিবের মোবাইল ফোনটি নদীতে ফেলে দেয় কিন্তু সিম গুলো নিয়ে যায়।
এরপর আলামিন চলে যায় সফিপুর তার এক বন্ধুর কাছে। সেখান থেকে তার এক বন্ধুর কাছ পরিবার ও প্রেমিকার সাথে কথা বলার জন্য একটি পুরাতন মোবাইল সেট ধার চায়। আর বলে, আমার সেট নাই। ঐ বন্ধু তার একটি ব্যবহৃত পুরাতন সেট দেয়। তখন সে ঐ সেটে সজিবের সিম কার্ড ভরে প্রথমে সজিবের মাকে ফোন দিয়ে বলে, সজিব কই? তখন তার মা বলেন, সজিব তো তিনদিন যাবৎ বাড়িতে নাই। এরপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় আলামিন। পরের দিন আবার ফোন দিলে সজিবে বাবা ফোন রিসিভ করে, তখন আলামিন তাঁকে বলে, আপনার কাছে সজিব বড়, না টাকা বড়। সজিবকে পেতে হলে কালকের মধ্যে ১৫ লক্ষ টাকা দিতে হবে। তা না হলে ছেলেকে আর পাবেন না। তখন সজিবের বাবা কাকুতি মিনতি করে তার কাছ থেকে সময় বাড়াতে থাকে আর বিষয়টি পুলিশকে জানায়।
কিন্তু আসামি ধুরন্দর আলামিন সফিপুর থাকলেও ঐ সেট ও নম্বর দিয়ে কখনোই অন্য কারো সাথে কথা বলতো না। সব সময় মির্জাপুর থানার পাকুল্লা এলাকায় এসে কথা বলত। আর পুলিশকে ধোকা দিতে থাকে। কথা বলা শেষ হলে সেট বন্ধ করে সে আবার সফিপুর এলাকায় চলে যায়। ফলে পুলিশ তাকে শনাক্ত করতে বা তার অবস্থান নিশ্চিত হতে পারছিল না।
এরপর মির্জাপুর থানার পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুরাদুজ্জামান ডিবি’র এমআইএস শাখার সামছুজ্জানের সহযোগিতা নিয়ে মোবাইল সেটের আইএমইআই নম্বর ট্র্যাকিং করে ঐ সেটের পূর্বের ব্যবহারকারী ও তার নম্বর পায়। তখন ঐ ব্যবহারকারীকে গ্রেফতার করলে তার কাছ থেকে জানা যায়, তার কাছ থেকে সেটটি ধার নিয়েছে। এরপর সফিপুর থেকে আসামি আলামিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুমন কর্মকার এর আদালতে আসামি আলামিন ফৌজদারী কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি মূলক জবান্দবন্দি দেয়।
মির্জাপুর থানার পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুরাদুজ্জামান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।