ঘাটাইল প্রতিনিধি : অতিদরিদ্রদের কর্মসৃজন প্রকল্পে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতাসহ অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম রয়েছে।
তবে এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না বলে দাবি তাদের; এক অনুসন্ধানে ৪০ দিনের কর্মসূচির এমন চিত্র ধরা পড়েছে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সাগরদিঘি ইউনিয়নে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চারটি প্রকল্পে ৮২ জন শ্রমিকের বিপরীতে সাগরদিঘি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) বরাদ্দ পায় ১৩ লাখ ১২ হাজার টাকা।
এর আওতায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে রাস্তা মেরামতের কাজ।
একজন শ্রমিক ৪০ দিন কাজ করলে তাঁর মজুরি হবে ১৬ হাজার টাকা। দুই ধাপে দেওয়া হয় মজুরির টাকা; ওই ইউনিয়নের শ্রমিকরা প্রথম ধাপে টাকা না পেলেও দ্বিতীয় ধাপের টাকা পেয়েছেন।
অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায় –
এই প্রকল্পের শ্রমিকের তালিকায় এক হাজার ১৪৬ নম্বরে নাম রয়েছে ঘাটাইলের ফুলমালিরচালা কারিগরি বিএমএ কৃষি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হাসান আলীর (৩৪)।
তাঁর ভাষ্য, একদিন করিমগঞ্জ গ্রামের মেহের আলী নামের একজন জানান কোনো এক কাজে চেয়ারম্যান তার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি এবং ছবি চেয়েছেন।
পরে সরল বিশ্বাসে দিয়ে দেন। এরপর তাঁর মোবাইল ফোনে ৭ হাজার ২৫০ টাকার একটি বার্তা দেখতে পান।
পরে টাকা তুলে নিয়ে যান মেহের আলী। তিনি সাগরদিঘি ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। দীর্ঘদিন ছিলেন সিঙ্গাপুরে। তাঁরও নাম রয়েছে তালিকায়।
মামুন হোসাইন প্যারা শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন করিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৫ দিন আগে যোগ দিয়েছেন রফিক-রাজু স্কুলে।
তালিকায় তাঁরও নাম রয়েছে। তবে তালিকায় দেওয়া ফোন নম্বরটি তার নয়। কেউ একজন কাগজপত্র নিয়ে গেছে বলে দাবি তার।
তালিকায় নাম রয়েছে ডিলারশিপ ব্যবসায়ী মজনু মিয়ার; সাগরদিঘি বাজারে মীম ইলেক্ট্রনিক্স, জোরদিঘি বাজারে মায়ের দোয়া ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান রয়েছে তার।
আর পল্লী চিকিৎসক কামাল হোসেনের জোরদিঘি বাজারে ফার্মেসি রয়েছে; নাজমুল হক চাকরিজীবী, মাসুদ রানা সাগরদিঘি ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর।
বাদ যায়নি প্রভাবশালীদের নামও।
সাগরদিঘি এলাকার যে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী আছেন তাদের মধ্যে সোহরাব আলী অন্যতম। কাদের সিকদার প্রায় দশ বিঘা সম্পত্তির মালিক।
তার রয়েছে লেবু ও কলার ব্যবসা। বাড়িতে দালানসহ কাদের সিকদারের সাগরদিঘি বাজারে রয়েছে সিকদার মার্কেট।
কাজ না করে অর্থ আত্মসাৎ করতে চেয়ারম্যানের তৈরি অসংগতিপূর্ণ শ্রমিকের তালিকা দেখে বিব্রত ইউপি সদস্যরা।
ইউপি সদস্যদের বক্তব্য –
২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, তাঁর জানামতে সাগরদিঘি ইউনিয়নে শ্রমিক দিয়ে কোনো কাজ হয়নি।
তাঁর এলাকা থেকে ৯ জনের মোবাইল ফোনের সিমকার্ড সংগ্রহ করে দিতে বলেন চেয়ারম্যান। পরে ছয়টি চেয়ারম্যান রেখে তিনটি সিম তাঁকে দেন।
সেই তিনটি সিমে সাত হাজার করে মোট ২১ হাজার টাকা জমা হয়। সেখান থেকে নাকি চেয়ারম্যান ১০ হাজার টাকা চান।
৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ফরহাদ আলী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূজন প্রকল্পে দশ টাকার কাজ হয়েছে, এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না।
৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য সুরুজ মিয়া জানান, তাকে ৯ জন শ্রমিক দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
শ্রমিক নামধারী লোকজনের মোবাইল ফোন থেকে টাকা উত্তোলন করে জমা করা হয় ইউপি সচিবের কাছে।
পরে তা ভাগবাটোয়ারা হয়। দু’একজন বাদে বাকি ইউপি সদস্যদের একই সুর।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য –
তবে শ্রমিকের নামের তালিকায় স্কুল-কলেজ শিক্ষক, চাকরিজীবী ও প্রভাবশালীদের নাম থাকাসহ অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান হেকমত সিকদার।
তিনি বলেন, ‘সারাদেশে যেভাবে কাজ হয়, এখানেও সেভাবে হয়েছে। শ্রমিকও কাজ করেছে, ভেকু (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়েও কাজ করা হয়েছে।
কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা (ট্যাগ অফিসার) উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমানের দাবি, শ্রমিক উপস্থিতি ছিল শতভাগ, কাজ হয়েছে ভালো।
ঘাটাইল ইউএনও মুনিয়া চৌধুরী জানান, তার যোগদানের আগেই ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে এমনটা ঘটে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সম্পাদনা – অলক কুমার