টাঙ্গাইল শহরের মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ কলেজের গভর্নিংবডি কমিটির সভাপতি মনোনীত করে কুমিল্লার বাসিন্দা মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর থেকেই জেলাব্যাপী শুরু হয়েছে নানামূখী আলোচনা-সমালোচনা। কুমিল্লার একজন বাসিন্দাকে টাঙ্গাইলের একটি কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দেয়ার জেলায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে জেলাবাসীর একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে, টাঙ্গাইলে কি কোন শিক্ষানুরাগী নাই?
জানা যায়, টাঙ্গাইল শহরের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয় গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। তিনি টাঙ্গাইলের স্থানীয় বাসিন্দা নন। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। তিনি টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ের জামাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই প্রভাব খাটিয়ে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মনোনীত হয়েছেন। এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন, বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক নেতৃবৃন্দ।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, গর্ভনিংবডি গঠনের জন্য অভিভাবক প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি, হিতৈষী সদস্য, দাতা সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নির্বাচনের লক্ষ্যে গত ৩০ এপ্রিল তফসীল ঘোষণা করা হয়। ৩০ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত মনোনয়ন পত্র বিতরণ করা হয়। ৬ মে থেকে ৭ মে পর্যন্ত মনোনয়ন পত্র জমা নেয়া হয়। ৮ মে মনোনয়ন পত্র বাছাই করা হয়। ১২ মে মনোনয়ন আপত্তি ও নিষ্পত্তি করা হয়। ১৩ মে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা হয়। ১৪ মে চ‚ড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ও প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়। ১৮ মে কলেজ প্রাঙ্গনে ভোটারদের ভোট গ্রহণ করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকার গত ২৩ জুন অধ্যাপক মুহম্মদ নজরুল ইসলামকে সভাপতি ও মো. শফিকুল ইসলামকে বিদ্যোৎসাহী সদস্য মনোনীত করে কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর চিঠি প্রেরণ করেন। তবে কলেজে খোঁজ নিলে জানা যায়, অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে কলেজের কেউই তাকে আগে থেকে চিনতো না।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের মন্তব্য –
এই বিষয়ে মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজনের অভিভাবক বলেন, যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি টাঙ্গাইলের, তাই টাঙ্গাইলের মানুষ এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হলে তিনি প্রতিষ্ঠানটি ভালভাবে পরিচালনা করতে পারবেন। এছাড়া তিনি এখনো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকত করছেন। তাই তিনি ইচ্ছা করলেই এই প্রতিষ্ঠানে সময় দিতে পারবেন না। তাই টাঙ্গাইলের অন্য যেকোন শিক্ষিত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান করার দাবি তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বেশ বিভিন্ন বিভাগের অনেক শিক্ষক ঘটনাটির তীব্র প্রতিবাদ জানান। এসময় তারা বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলে কি কোন শিক্ষানুরাগী নাই? কুমিল্লার মানুষকে ধরে এনে আমাদের টাঙ্গাইলের কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি বানাতে হবে?
জেলার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য –
এবিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রদলের আহবায়ক দূর্জয় হোড় শুভ বলেন, টাঙ্গাইলের কোন শিক্ষানুরাগী কলেজটির সভপতি নির্বাচিত হলে, যে কোন সমস্যা নিয়ে দ্রæততম সময়ে তার যোগযোগ করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যেত। এতে কলেজের ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেত বলে মন্তব্য করেন এই ছাত্র নেতা।
জেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব এমএ বাতেন বলেন, কলেজটি টাঙ্গাইলের। সেই ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলের কেউ যদি সভাপতি মনোনীত হতো, তাহলে কলেজ, কলেজের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করতে পারতো।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়েত ইসলামী টাঙ্গাইলের আমীর আহসান হাবীব মাসুদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে একজন শিক্ষক সবচেয়ে উপযোগী। তবে সেটা টাঙ্গাইলের কোন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি হলে আরো ভালো হয় বলে মতমত প্রকাশ করেন তিনি।
জুলাই যোদ্ধা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সাবেক আহবায়ক আলামিন বলেন, যিনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের ভালমন্দের খোঁজখবর সবসময় নিতে পারবে তাকেই এই দায়িত্বে দেয়া উচিত। সেটা আমাদের টাঙ্গাইল জেলার মানুষ হলে ভালো হয়। টাঙ্গাইলের মানুষ শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এগিয়ে আছে। কুমিল্লার একজন মানুষকে টাঙ্গাইলের একটি কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি করাটাকে টাঙ্গাইলের জন্য অপমান হিসেবে দেখছেন তিনি।
জেলা বিএনপির সভাপতি ও কলেজের গর্ভনিংবডির সভাপতি প্রার্থী হাসানুজ্জামীল শাহীন বলেন, এটা টাঙ্গাইলবাসীর জন্য অপমানজনক। টাঙ্গাইলে কি এরকম কোন শিক্ষানুরাগী নাই, যিনি মাহমুদুল হাসান কলেজের পরিচালনা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হতে পারে? তিনি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। এসময় তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের স্বনামধন্য এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির জন্য যাকে মনোনীত করা হয়েছে, তার বাড়ি টাঙ্গাইলে না। তার শ্বশুর বাড়ি টাঙ্গাইলে। তার শ্বশুর আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তিনি ভুল বুঝিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সভাপতি হয়েছেন।
এসময় তিনি মেজর জেনারেল মাহমুদল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে টাঙ্গাইলের যে কোন শিক্ষিত, ভদ্র ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিকে সভাপতি করার দাবি জানান।
কলেজ কর্তৃপক্ষের মন্তব্য –
এ ব্যাপারে মাহদুল হাসান কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত হয়ে আসেন ছয় মাসের জন্য। তারপর আরো তিন মাসের জন্য বর্ধিত করা হয়। এরপর তিনিই আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গভর্নিংবডির সভাপতি হিসেব মনোনীত হয়ে আসেন। এখন আমাদের উনার সাথেই কাজ হবে। এবার তিনি সভাপতি হলেও আমরা প্রতিষ্ঠান থেকে তার নাম প্রস্তাবনা পাঠাই নাই। আমরা সভাপতি পদে তিনজন ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য পদে তিনজনের নাম পাঠিয়েছিলাম।