আরমান কবীর : সম্প্রতি টাঙ্গাইলে সড়ক-মহাসড়ক বা আঞ্চলিক সড়ক, সব সড়কেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে।
সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রানহানির সংখ্যাও।
বিশেষ করে এ বছর মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর তালিকায় বার বার যুক্ত হয়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী বা কিশোরদের নাম।
শুধু মাত্র সেপ্টেম্বর মাসেই দুইজন এসএসসি ও দুই জন দাখিল পরীক্ষার্থী সখীপুর ও দেলদুয়ার ও ঘাটাইলে মর্মান্তিক মোটরসাইকেল দুর্ঘনায় প্রাণ হারিয়েছে।
আরো পড়ুন – মেয়েদের উত্যক্তকারীদের হামলায় প্রতিবাদকারী যুবকের মৃত্যু
জেলার সবচেয়ে দূর্ঘটনা প্রবন উপজেলা হচ্ছে সখীপুর।
এখানে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মোটরসাইকেল কেন্দ্রিক অপরাধ সংগঠনের প্রবনতাও বেড়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের (সিপিএস) সহযোগী অধ্যাপক মো. বশীর উদ্দীন খানের মতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।
সারা দেশেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বিপদজনক অবস্থায় পৌছেঁছে।
পরিসংখ্যান কি বলছে?
বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, আগষ্ট মাসে সারাদেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৯ জন নিহত হয়েছে।
এর মধ্যে ১৮৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৭২ জন।
মোট দুর্ঘটনার তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ, নিহতের হার ৩৩ দশমিক ১৪ শতাংশ।
আরো পড়ুন – ধর্ষক গ্রেপ্তারে ভূঞাপুরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আলটিমেটাম
টাঙ্গাইল জেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্কুল-কলেজের ছাত্রদের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের কিছু খন্ডিত চিত্র নিচে তুলে ধরা হল।
গত মাসে টাঙ্গাইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চিত্র –
টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় চলমান দাখিল পরীক্ষার্থী নাইম খান (১৫) ও শাকিল খান (১৫) নামে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আরও এক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছে।
শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১১টার দিকে উপজেলার সংগ্রামপুর ইউনিয়নের এগারকাহনিয়া আমুয়াবাইদ গ্রামে ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সখীপুরের আদনান (১৫) নামে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিয়াম (১৬) নামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে মোটরসাইকেল ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শামীম আল মামুন (২৫) নামের এক ছাত্রের চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে।
আরো পড়ুন – হত্যাকারী আইনের আওতায় আসবে কি? শঙ্কায় নিহত শিহাবের পরিবার
শনিবার (২৫ জুন) দুপুরে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে মঙ্গলবার (৩ মে) বিকালে দুই মোটরসাইকেলেরে মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ কিশোরের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হল উপজেলার যদুরনাথপুর ইউনিয়নের শ্রীহরিপুর পাতলাচড়ার গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে আল-আমিন (১৫), অপরজন আছর আলীর ছেলে রিপন (১৫)।
রবিবার(২০ মার্চ) বিকেলে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ট্রাকচাপায় রুপম খান (১৮) ও নিশাত খান (১৮) নামের মোটরসাইকেলের আরোহী দুই কলেজছাত্র নিহত হয়।
দুর্ঘটনা পরবর্তী চিত্র –
এই সব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রানহানি হওয়াতে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই টাঙ্গাইলের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে।
এই সব ঘটনায় অকালে পঙ্গত্বু বরণ করে নিতে হচ্ছে অনেক ছাত্রকে।
এ ছাড়া মোটরসাইকেল কেন্দ্রিক অপরাধ সংঘটনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।
শুধু মাত্র মোটরসাইকেল থাকার কারনে নৃশংস ভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে টাঙ্গাইলের সরকারী এমএম আলী কলেজের অর্নাস প্রথম বর্ষের ছাত্র নাগরপুরের আরিফ মিঞা (২১) নামের এক কলেজ ছাত্রকে।
মোটরসাইকেল নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন টাঙ্গাইল মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করা আজহারুল হাবিব ও তানজিরুল রহমান।
তাদের মতে, কিশোর বয়সের ছেলেদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে, তারা পরিবারের অনুশাসন মানতে চায় না।
মোটরসাইকেল পেলে তারা ওভার স্পিডে চালায়। বিশেষ করে যারা বন্ধু কিম্বা আত্নীয় স্বজনের মোটরসাইকেল নিয়ে মাঝে মাঝে চালায়; তাদের মোটরসাইকেলের উপর নিয়ন্ত্রন কম থাকে। ফলে এরাই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকে বেশি।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ঝান্ডা চাকলাদার বলেন, স্কুল-কলেজের মোটরসাইকেল আরোহী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই ট্রাফিক সিগনালের পরোয়া করে না।
প্রায় ক্ষেত্রেই মোটরসাইকেলের রেসিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তারা। ফলে অকালে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে কিম্বা বরণ করছে পঙ্গুত্ব।
এসব স্কুল-কলেজের ছাত্রদের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের সংগঠন বিভিন্ন ফোরামে কাজ করছে।
বিশেষ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স বিহীন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা যেন সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালাতে না পারে সে বিষয়ে প্রশাসনের আরো সতর্ক নজরদারি বাড়ানোর জোর দাবি তাদের।
এছাড়া এই সংগঠনের পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে মোটিভেশনাল কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে আরো জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের বক্তব্য –
টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) জয়ব্রত পাল বলেন, জেলায় প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অপ্রতুল।
তারপরেও উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত চেকপোষ্ট বসিয়ে টিনেজার মোটরসাইকেল আরোহীদের জরিমানা সহ মোটিভেশনাল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
টাঙ্গাইল শহরের জন্য পৃথক একটি টিম প্রতিনিয়ত টহল কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কার্যক্রম আরো গতিশীল করার জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে ।
উঠতি বয়সের ছেলেরা মোটরসাইকেলকে কেন্দ্র করে যেন কোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়েও কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের (সিপিএস) সহযোগী অধ্যাপক মো. বশীর উদ্দীন খান বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের হিরোইজম কাজ করে।
বন্ধু-বান্ধবের সাথে মোটরসাইকেল নিয়ে রেসিং করা এই বয়সের একটা বৈশিষ্ট্য।এই রেসিং করেতে গিয়ে তারা মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে তারা।
তাদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া রোধ করতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে তাদের অভিভাবকগণ।
বাসায় তাদের বোঝাতে হবে দূর্ঘটনায় তাদের জীবনে কি ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষার্থীরা যেন কোনভাবেই মোটরসাইকেল কেন্দ্রিক অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সুশীল সমাজেরও বড় একটা ভূমিকা পালন করতে হবে। সম্পাদনা – অলক কুমার