টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল : ওষুধ ক্রয় টেন্ডারে দেড় কোটি টাকা ভাগাভাগি!

নিজস্ব প্রতিবেদক : টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরেই এমএসআর (মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল রিইকুইজিট) সামগ্রী ক্রয় করতে ঔষধপত্র, লিলেন, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, গজ ব্যান্ডেজ কটন, কেমিকেল রি-এজেন্ট এবং আসবাবপত্র সরবরাহে বিভিন্ন অনিয়ম এখন নিয়মে পরিনত হয়েছে।

এতে করে সরকার মোটার অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও লাভবান হচ্ছেন হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের এমএসআর (মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল রিইকুইজিট) সামগ্রী ক্রয় করতে ঔষধপত্র, লিলেন, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, গজ ব্যান্ডেজ কটন, কেমিকেল রি-এজেন্ট এবং আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য ৬টি গ্রুপে দরপত্র আহ্বান করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা।

সেই দরপত্রে অংশ নেয় প্রান্তিক এন্টারপ্রাইজ, লোটাস সার্জিকাল এবং শামছুল হক ফার্মেসিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ডজনখানেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সহযোগিতায় ঠিকাদারদের একটি সিন্ডিকেট। পরবর্তীতে এই সিন্ডিকেট এমএসআর সামগ্রী সরবরাহের জন্য ঠিকাদারদের সাথে দর কষাকষি শুরু হয়ে। এ নিয়ে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বাসভবনে একজন ঠিকাদারের সাথে বৈঠকেও বসেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

সে সময় ওই ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য এক কোটি ৮০ লাখ টাকা দাবি করেন তারা। সেই দাবি অনুযায়ী এত টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সিন্ডিকেটের সদস্যরা অন্য ঠিকাদারদের সাথে বৈঠকে বসেন। পরে সেই কাজ প্রায় দেড় কোটি টাকার বিনিময়ে প্রান্তিক এন্টারপ্রাইজ, লোটাস সার্জিকাল এবং শামছুল হক ফার্মেসিকে কাজ দেয়া হয়। আর এই দেড় কোটি টাকা হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকার দলীয় লোকজন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা হয়।

এদিকে ওই তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএসআর সামগ্রী সরবরাহ করার আগেই দরপত্রে বরাদ্দ প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকার মধ্যে দেড় কোটি টাকাই সিন্ডিকেটের সদস্যদের দিয়ে দেয়ায় তারা কাজ শুরু করতে বিলম্ব করে। পরে তারা হাসপাতালের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে একই দরপত্রের জন্য আবার প্রায় আট কোটি টাকা বরাদ্দ আনেন ঠিকাদার ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরে সেই বরাদ্দকৃত টাকার অর্ধেক খরচ করে বাকি চার কোটি টাকাই চলে যায় ঠিকাদারদের পকেটে।

এদিকে একই কায়দায় এবারও ২০২০-২০২১ অর্থবছরের এমএসআর (মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল রিইকুইজিট) সামগ্রী ক্রয় করতে ঔষধপত্র, লিলেন, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, গজ ব্যান্ডেজ কটন, কেমিকেল রি-এজেন্ট এবং আসবাবপত্র সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পূর্বের ঠিকাদার ও সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এতে সহযোগিতা করছেন হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

এরই ধারাবাহিকতায় এবারও ২০২০-২০২১ অর্থবছরের এমএসআর (মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল রিইকুইজিট) সামগ্রী ক্রয় করতে ঔষধপত্র, লিলেন, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, গজ ব্যান্ডেজ কটন, কেমিকেল রি-এজেন্ট এবং আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য ৬টি গ্রুপে দরপত্র আহবান করে।

এই দরপত্রে টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা অংশ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে প্রান্তিক এন্টারপ্রাইজ, লোটাস সার্জিক্যাল এবং শামছুল হক ফার্মেসিসহ ১৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে অন্যান্য সকল দরপত্র বাতিল করে হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তার ও ঠিকাদারের যোগ সাজসে নিজেদের পছন্দমত ঠিকাদার রাফি ও সাফি মেডিকেল হক, জুয়াইরিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ফারুক ট্রেডার্স ও মক্কা ট্রেডার্সকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে প্রস্তাব প্রেরণ করে।

পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৮ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৬ বিধি ভঙ্গ করে অজ্ঞাত কারণে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা। এ ঘটনায় প্রান্তিক এন্টারপ্রাইজ, লোটাস সার্জিকাল এবং শামছুল হক ফার্মেসি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।

অনিয়ম আর একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। আর এতে করে এই হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা দিন দিন ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। এছাড়া প্রতিবছর এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেয়া হচ্ছে। বিনিময়ে সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঠিকাদারের কাছ থেকে পাচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। এতে করে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে এই টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের খাতে।

তবে প্রতিবছর যে টাকার দরপত্র আহবান করা হয় সেই অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করলে টাঙ্গাইল জেলাবাসীর চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তারা জানান, প্রথমে দরপত্রের পুরো টাকাই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। পরে আবার আহবানকৃত দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী কাজ করার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় পুনরায় আবার বরাদ্দ এনে তার অর্ধেক কাজ করা হয়।

টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. খন্দকার সাদেকুর রহমান জানান, এ বিষয়ে হাসপাতালের অ্যাকাউন্ট সাহেব ভাল বলতে পারবেন। আপনি অফিসে আসেন। আপনার সাথে সামনাসামনি কথা বলি।

এ বিষয়ে হাসপাতালের হিসাব রক্ষক মজনু মিয়া জানান, এ বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিচালক সাহেবই ভাল বলতে পারবেন। সম্পাদনা – অলক কুমার