যে মানুষটি পাহাড় সমান দারিদ্র্যতা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করলেন, সেই মানুষটিই এশিয়া মহাদেশের অন্যতম একজন দানবীর ও মানবসেবক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেন। যে মানুষটি অর্থের অভাবে মায়ের চিকিৎসা করাতে পারলেন না, সেই মানুষটির প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে এখন প্রতিদিন প্রায় দুই সহস্রাধিক রোগীকে সহজলভ্য চিকিৎসা দান করা হচ্ছে। একটি শিক্ষা কেন্দ্রের অভাবে যেখানে নারী শিক্ষা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, এই মানুষটির অবদানেই আজ হাজার হাজার নারী সুশিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের নারী সমাজ আলোকিত করছে।
এই মানুষটি হলেন- টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা সদরের মির্জাপুর গ্রামের দানবীর রায় বাহাদুর রনদা প্রসাদ সাহা। উত্থান একাদশীর হিসেব মতে (১ নভেম্বর) শনিবার তার ১২৯ তম জন্মজয়ন্তি। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশের কৃতি সন্তান, প্রখ্যাত লোকহিতৈষী দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা মহাশয়ের ১২৯ তম জন্মজয়ন্তি নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর রনদা নাট মন্দিরে পালন করা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন কুমুদিনী হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রদীপ কুমার রায়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট নিহাদ কবির (ব্যারিস্টার এ্যাট ল)। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রনদার একমাত্র পৌত্র কুমুদিনী কল্যান সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা, কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের পরিচালক রণদার দৌহিত্র মহাবীর পতি (চন্দন)। এছাড়াও অনুষ্ঠানে দেশের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীগণ উপস্থিত থাকবেন বলে কুমুদিনী পরিবার সূত্র জানিয়েছেন।
জানা যায়, বিগত ১৮৯৬ সালের উত্থান একাদশীতে ঢাকা জেলার উপকন্ঠ সাভারের কাছুর গ্রামে মাতুলালয়ে মামার বাড়িতে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা। তার পিতার নাম দেবেন্দ্র নাথ সাহা পোদ্দার। প্রতি বছর উত্থান একাদশী তিথিতে রনদা প্রসাদ সাহার জন্মজয়ন্তি পালন করা হয়। রনদা প্রসাদ সাহা ছিলেন একজন কর্মবীর এবং মানব সেবক। পিতার অভাব এবং টানাটানির সংসারে অতিকষ্টে মানুষ হয়েছেন রনদা প্রসাদ সাহা। পিতা দেবেন্দ্র নাথ সাহা চাকুরী করতেন জমিদারদের সেরেস্তাখানায়। তার অল্প আয়ে সংসার চালাতে পেরে উঠলেন না দেবেন্দ্র নাথ। তার মধ্য দিয়েই রনদাকে লালন পালন করতেন। বাল্যকালে রনদা ছিলেন ডানপিটে এবং দুরন্ত।
রনদার বয়স যখন ৭ বছর তখন তারঁ ভাগ্যে নেমে আসে বিপর্যয়। শিশু বয়সেই তিনি হারান মা কুমুদিনীকে। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। ওষুধ ও ডাক্তারের ভিজিট দিতে পারবে না, তাই সেদিন কোন ডাক্তার আসেনি রনদার বাড়িতে। শত চেষ্টা করেও গর্ভধারীনী ও স্নেহময়ী মাকে বাচাঁতে পারেননি কিশোর রনদা। স্বচোখে মায়ের মুত্যু দেখার পর রনদার জীবনে বিরাট পরিবর্তন আসে। সেদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ‘আমার মায়ের মতো আর কোন মাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দিবো না’। মায়ের মৃত্যুর ৬ মাস পর পিতা দেবেনাদ্র নাথ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিমাতার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে পড়েন রনদা। রনদার বয়স যখন ১৪ তখন তিনি ভাগ্য অন্বেষনে চলে যান ভারতের কলকাতায়। প্রবাস জীবন হয়ে ওঠে আরও কষ্টের। জীবন বাচাঁতে এমন কাজ নেই যা রনদা করেননি।
পত্রিকা বিক্রি ও গাড়ি ধোয়া মোছার কাজ তিনি যত্নের সঙ্গে করেছেন। যখন তার বয়স ১৭ বছর তথন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্যান্য বাঙ্গালীর মতো তিনিও বাঙ্গালী সেচ্ছাসেবকের সঙ্গে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে যোগ দেন এবং মেসোপটেমিয়ায় চলে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বীরত্বপুর্ণ ভুমিকার জন্য তিনি নব প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন প্রাপ্ত হন। এ সময়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পরে কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠালাভ করেন বিদ্রোহ কবি হিসেবে এবং রনদা প্রতিষ্ঠালাভ করেন ব্যবসায়ী হিসেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর রনদার জীবনে নবতর দিকদর্শন লাভ করেন।
প্রথমত- গরিব ও দুস্থ মানুষের সেবা। দ্বিতীয়ত- ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ গঠন। তৃতীয়ত- শৃংখলাবোধ। এই তিনটি আদর্শকে সামনে রেখে রেলওয়ে বিভাগে স্বল্প বেতনের চাকুরী দিয়ে রনদা কর্মজীবন শুরু করেন। রনদার বয়স যখন ৩৫ বছর তখন তিনি রেলওয়ের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। কয়লার ব্যবসায় রনদা দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ৫৫টি জাহাজসহ বিআরএস কোম্পানী ক্রয় করেন। রনদা প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েও নিজের জন্য কিছুই করেননি। কষ্টার্জিত সব ধনসম্পদ আর্তমানবতার সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন। মির্জাপুর লৌহজং নদীর তীর ঘেসা এশিয়াখ্যাত ১০৫০ বেডের কুমুদিনী হাসপাতাল তাঁর জ্বলন্ত সাক্ষী। তার অন্যান্য কীর্তির মধ্যে নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতেশ্বরী হোমস, টাঙ্গাইল সদরে কুমুদিনী মহিলা কলেজ (বর্তমানে সরকারী), মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ (বর্তমান সরকারী) উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া তিনি মির্জাপুরে একটি মহিলা মেডিকেল কলেজ করার জন্য চারতলা ভবনের দ্বিতীয়তলা সমাপ্ত করেন। বর্তমানে ভবনটি মির্জাপুর শহীদ ভবানী প্রসাদ সাহা সরকারি কলেজ। ভবনের কাজ সমাপ্ত করার আগেই ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের এদেশীয় দোশররা তাকে এবং তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবিসহ কয়েকজনকে নারায়নগঞ্জের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তখন রণদা প্রসাদ সাহা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও তার একমাত্র পৌত্র রাজীব প্রসাদ সাহা তার ইচ্ছা ইতিমধ্যেই সমাপ্ত করেছেন। বিগত ২০০১ সালে কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজে প্রতিষ্ঠা পায়। কলেজটি বর্তমানে ৭ শতাধিক ছাত্রী রয়েছেন। যার মধ্যে ৪০ ভাগ বিদেশী ছাত্রী রয়েছেন বলে কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের অফিসার ইনচার্জ রতন চন্দ্র সরকার জানিয়েছেন।











